দুই পায়ে বাংলাদেশ

অনেক দিন থেকেই ভাবছিলাম একটি এক্সট্রিম ট্যুর দেবো। সঙ্গি খুঁজছিলাম কার সঙ্গে এই ট্যুর দেওয়া যায়। কথা হচ্ছিল ইশতিয়াক আরেফীনের সঙ্গে। দুই জনে একমত হয়ে ঠিক করতে বসলাম রুট প্ল্যান, বাজেট, থাকা-খাওয়ার বিষয়সহ অন্যান্য সবকিছু। এর আগে যেহেতু আমি এই রাস্তায় সাইকেল চালিয়েছিলাম তাই আমার জন্য রুট প্ল্যান করতে সহজই হল। রুট প্ল্যান করার পর বাকি ছিল তারিখ ঠিক করা আর অর্থ যোগার করা। ভ্রমণে দুজনের জন্যই আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল ভাল ব্যাগ। ব্যাগের ব্যবস্থাও হয়ে গেল বাবু ভাইয়ের মাধ্যমে। বাবু ভাই ভারত থেকে আমাদের দুই জনের জন্য দুটি ব্যাগ নিয়ে আসলেন। দুইজনে মিলে সময় হিসেবে ঠিক করলাম নভেম্বর মাসকে। আর ঠিক হল আমরা যাব ‘ভ্রমণ বাংলাদেশে’র ব্যানারে। সবকিছু ঠিকঠাক করে দুইজনে মিলে ঝাপিয়ে পড়লাম অর্থের সন্ধানে। কোন ধরনের স্পন্সর ছাড়াই শুধু নিজেদের শুভাকাঙ্খি ও বড় ভাই-বোনদের কাছ থেকে হাত পাতা শুরু করলাম। অর্থের একটা অংশ আসল ‘ভ্রমণ বাংলাদেশ’ থেকে আর একটা আসলো ‘ট্র্যাভেলার্স অফ বাংলাদেশ’ থেকে বাকিটা আমাদের নিজেদের পকেট থেকে।

যেই কথা সেই কাজ। নভেম্বরের ৬ তারিখে বাসে করে রওনা দিলাম তেতুঁলিয়ার উদ্দেশে। সঙ্গী হলেন বাবু ভাই এবং পান্থ ভাই। ভোর ৪ টার দিকে পৌঁছালাম তেতুঁলিয়া। আমাদের প্ল্যান ছিল বাংলাবান্দা জিরো পয়েন্ট থেকে হাঁটা শুরু করবো। তেঁতুলিয়া থেকে বাংলাবান্দা প্রায় ১৭ কিলোমিটারের মত। এত ভোরে কোন যানবাহন পাওয়া যাচ্ছিল না। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে একটি ভ্যান পাওয়া গেল। সেটা ঠিক করে রওনা দিলাম বাংলাবান্দার দিকে। রাস্তার দুই পাশ দিয়ে ভারতীয় বর্ডার দেখা যাচ্ছিল। হঠাৎ দেখতে পেলাম কাঞ্চনজঙ্ঘা পাহাড়। বাবু ভাইয়ের কাছ থেকে জানতে পারলাম এটি পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম পাহাড়। কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখে সবাই উত্তেজিত, লোকজন কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার ভারতে যায় আর আমরা বাংলাদেশ থেকেই দেখছি এই সৌন্দর্য্য। যদিও এখান থেকে অনেক অনেক দূরে।

ছবি: মীর শামছুল আলম বাবু

বাংলাবান্দা থেকে হাঁটা শুরু করলাম তেঁতুলিয়ার উদ্দেশে। পথের পাশের এক দোকান থেকে বের হয়ে এক লোক আমাদের থামালেন। বললেন, ‘ভাই দুইদিন আগে আপনাদের ছবি দেখছি পত্রিকায়।’ দুইজনের হাতে চকলেট দিয়ে বললেন, ‘ভাই যদি কিছু মনে করেন, এই চকলেটগুলা নেন। গরীব মানুষ তাই বেশি কিছু করতে পারলাম না।’ তাঁর এই ব্যবহারে আমরা সবাই অভিভূত।

প্রথম দিন এসে রাত্রি যাপন করলাম তেতুঁলিয়া জেলা পরিষদ ডাকবাংলোতে। দ্বিতীয় দিন তেঁতুলিয়া বাজারে নাস্তা করার জন্য ঢুকলাম, খাওয়া শেষে যখন হাঁটা শুরু করবো তখন দেখা হলো এক বয়স্ক লোকের সঙ্গে, তিনি ১৯৭১ সনে খুলনা থেকে তেতুঁলিয়া হেঁটে হেঁটে এসেছিলেন। আমাদের দেখে তাঁর সেই পুরনো দিনের ঘটনার মনে পড়ে যাওয়ার কথা বললেন। পথে হাঁটতে হাঁটতে দেখতে পেলাম একটি চা বাগান রাস্তার পাশেই, তবে বাগানের অর্ধেক বাংলাদেশ আর অর্ধেক ভারতে। চা বাগান দেখার পর পরই আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিল পান্থ ভাই আর বাবু ভাই, তাঁরা দুজন বাসে করে পঞ্চগড়ের উদ্দেশে চলে গেলেন। এভাবেই চলতে থাকলো আমাদের পথ চলা।

পথে এক জায়গায় বাঁশের মাচার উপর বসে বিশ্রাম নিচ্ছি। লোকজন এসে চারিদিকে ঘিরে ধরে নানারকম প্রশ্ন করা শুরু করল। সব উত্তর ইশতিয়াক ভাইই দিল। আমি চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকলাম। লোকজন নিজেরা নিজেরা কথা বলছিল আর কেউ কেউ আমাদের দুইজনকে বলছিল। আরো একজন পাওয়া আরো এক ডিগ্রি সরেশ মন্তব্য করল, এরা ছেলে ধরা।

এই কথা শুনে আমি আর ইশতিয়াক দ্রুত উঠে পড়লাম। হাঁটা শুরু করলাম অন্তত ছেলেধরা পরিচয়ে মার খাওয়ার কোন ইচ্ছা নেই আমাদের দুই জনের। পথে দুইজনেরই পানি শেষ হয়ে গেল। এক বাড়িতে ঢুকলাম পানি নেয়ার জন্য। বাড়ির লোক আমাদের টুল এনে দিয়ে বসতে দিলেন। আমাদের পানির বোতলগুলো বাড়িতে নিয়ে গেলেন। আমাদের বোতল তো ভরলেনই সঙ্গে একটা জগ দিয়ে পানি নেয় আসলেন সঙ্গে বিস্কিট। আমরা মোটামুটি অবাক ইশতিয়াক ভাই বেশি অবাক, কারণ আগে উনি এই ধরনের ট্যুর তেমন করেন নাই। কারণ তিনি বেশিরভাগ সময় পাহাড়েই ঘোরেন। পঞ্চগড় থেকে আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাবু ভাই ঢাকা চলে গেলেন, আর পান্থ ভাই সকালে রওনা দিলেন বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানীয় দেখার সঙ্গে।

ঠাকুরগাঁও যাওয়ার পথে সকালে নাস্তা করলাম জেমজুট মিলের পাশে এক হোটেলে। হোটেলটি জুটমিলের শ্রমিকদের জন্যই তৈরি করা হয়েছে। আমাদের আশেপাশে পুরুষ-মহিলারা যে যার মত খাচ্ছে আর অবাক হয়ে আমাদের দেখছে। খাবারের দাম খুবই সস্তা। আলুর ভর্তা, ডাল আর ডিম ভাজি দিয়ে সকালের নাস্তা শেষ করলাম।

বোদা পার হওয়ার সময় খাবারের জন্য হোটেল খুঁজছি এমন সময় এক লোক এসে আমাদের জিজ্ঞেস করে সব কিছু শুনে আমাদের নিয়ে এক হোটেলে ঢুকালেন এবং দুজনকে খাওয়া-দাওয়া করালেন। এভাবে একদিন চলতে চলতে দিনাজপুরে কান্তজিউ মন্দির দেখে দিনাজপুরের দিকে যাচ্ছিলাম দশমাইল নামে এক জায়গায় সন্ধ্যা হল।

সেখানকার লোকজন আমাদের উদ্দেশ্য জানতে পেরে বললো, এখন তো অন্ধকার হয়ে গেছে সামনে আর এগুনো উচিত হবে না। সামনের রাস্তা খুব একটা ভাল না, ডাকাতের উপদ্রপ আছে। আপনারা এখানেই হাঁটা বন্ধ করে দেন, আবার আগামীকাল হাঁটা শুরু করেন এখান থেকে। বাধ্য হয়ে ডাকাতের ভয়ে এইদিনের হাঁটা সেখানেই সমাপ্ত করলাম। দিনাজপুরে আমাদের সঙ্গ দেয়ার জন্য স্থানীয় বাবু ভাই ছিলেন। বাবু ভাই দিনজপুরে থেকে অনেক ঘুরাঘুরি করেন, আমার লেখা পত্রিকার কাটিংও সংগ্রহের রেখেছেন। শুধু আমার না ভ্রমণ কাহিনী পেলেই তিনি সংগ্রহে রেখে দেন। অসাধারণ হাসিখুশি একজন মানুষ।

দশ মাইল থেকে ফুলবাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত প্রায় দশটা বেজে গেল। কারণ পুরা ভ্রমণে দ্বিতীয় সর্বচ্চো হাঁটা দিলাম। প্রায় ৫০ কিলোমিটার। রুমে ঢুকেই বিছানায় শুয়ে পড়লাম। অনেক ক্লান্ত লাগছিল খেতেও ইচ্ছা করল না। ইশতিয়াক ভাই একাই খেতে গেলেন, খাওয়া-দাওয়া করে আমার জন্য সিদ্ধ ডিম নিয়ে ফিরে আসলেন। রাতে ঘুমালাম শুধু ডিম আর নাপা খেয়ে।

সকালে ঘুম থেকে উঠার পর গতকালে সকল ক্লান্তি শেষ হয়ে গেল। আবার হাঁটা শুরু করলাম রাতে থাকলাম ঘোরাঘাটের এক বোর্ডিংয়ে। ভাড়া মাত্র চল্লিশ টাকা। এমনিতে পঞ্চাশ টাকা কিন্তু আমরা যেহেতু হাঁটতে এসেছি তাই আমাদের জন্য চল্লিশ টাকা। এই অভিজ্ঞতায় আমাদের দুইজনের সাক্ষী হয়ে রইলেন পান্থ ভাই। পান্থ ভাই এই কয়দিনে উত্তর-বঙ্গের দর্শনীয় স্থানগুলো দেখছেন বাসে করে। আর সম্ভব হলে আমাদের সঙ্গে রাতে থাকছেন।

পরের দিন কোন রকম ঝামেলা ছাড়াই পৌঁছালাম গোবিন্দগঞ্জ। গোবিন্দগঞ্জ যখন পৌঁছাই তখন মাত্র বিকাল। দুইজনে মিলে ঠিক করলাম আরো কিছু দূর এগিয়ে যাই। হাঁটা শুরু করলাম সামনের দিকে। একসময় সন্ধ্যা হল গাড়ির সংখ্যাও কমতে থাকল। মহাস্থানগড়ের কাছাকাছি পৌঁছানোর পর একটু বেশিই নিরব হয়ে গেল সবকিছু। অনেকক্ষণ পর পর একটিদুটি গাড়ি আসে। উল্টা দিক থেকে এক লোক এসে আমাদের বললেন, ‘ভাই সামনে একটা লাশ পরে আছে, মনে হয় এক্সিডেন্টে।’

এই কথা শুনে ইশতিয়াক ভাই বেশ ভালই ভয় পেয়ে গেলেন। ইশতিয়াক ভাই বললেন, ‘ভাই চলেন ফিরে যাই।’ আমি কিছুতেই ফিরতে রাজি না। ইশতিয়াক ভাইকে সাহস দিয়ে সামনে এগিয়ে গেলাম। ইশতিয়াক ভাইয়ের ভয় দেখে আমারও একটু একটু ভয় লাগতে লাগল। অনেকক্ষণ যাবৎ হাঁটছি কিন্তু লাশের দেখা আর পাচ্ছি না। বিরক্ত হয়ে একজন আরেকজনকে বলতে থাকলাম লোকটা নিশ্চয়ই মিথ্যা বলছে। কি না কি অন্ধকারে দেখছে। এই কথা বলতে বলতেই দেখতে পেলাম রাস্তার পাশে ঝোপের কাছে এক লোক শুয়ে আছে। আমরা রাস্তার সাইট থেকে একদম রাস্তার মাঝখানে চলে আসলাম লোকটার কাছ থেকে দূরে থাকার জন্য। ইশতিয়াক ভাই তখন আমার হাত শক্ত করে ধরে আছেন। লোকটাকে ক্রস করে টর্চের আলো ফেললাম, দেখলাম রক্তের কোন চিহ্ন নেই। দুইজনেরই ভুল ভাঙ্গল ভয়ও চলে গেল। লোকটা আসলে ভবঘুরে অথবা পাগল হবে, বেঘোরে ঘুমাচ্ছে।

পরের দিন হরতাল, তাই আমাদের বেশ আনন্দের দিন। কারণ হরতাল মানে গাড়ির পে-পুঁ শব্দ নাই। একটু শান্তিতে হাঁটতে পারব। হরতাল থাকার কারণে পান্থ ভাইও ঠিক করেছেন আমাদের সঙ্গে হাঁটবেন।

স্কাউট গ্রুপের সঙ্গে আমরা। ছবি: স্থানীয় কেউ একজন

সকালে হাঁটা শুরু করলাম তিনজনে। হরতালের দিন তাই সত্যি সত্যি গাড়ি অনেক কম। পথে এক সাংবাদিক থামিয়ে ছবি তুললেন। হাঁটতে হাঁটতে আমাদের বিস্তারিতও শুনলেন। শেরপুর পৌঁছাইতে পৌঁছাইতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। পান্থ ভাইও অসুস্থ হয়ে গেলেন। পান্থ ভাইকে বাসে তুলে দেয়ার জন্য হোটেল থেকে বের হলাম দুই দিন পর ঈদ তাই ঢাকা থেকে ফেরার গাড়িগুলোতে অনেক ভিড়। কিন্তু ঢাকা যাওয়ার গাড়ি প্রায় ফাঁকাই যাচ্ছে। টিকেট কেটে আমরা ঢুকলাম খাওয়ার জন্য। পান্থ ভাই কিছুই খেলেন না। আমরা দুইজনে দুইটি তাবু নিয়ে বের হয়েছিলাম। পান্থ ভাইকে দিয়ে একটি তাবু ফেরত পাঠালাম। বাস ছাড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম, বাস ছাড়ার পর মনে হল আমরা আবার একা হয়ে গেলাম।

যমুনা সেতু টাঙ্গাইল হয়ে ঈদের আগের দিন পৌঁছালাম মির্জাপুর। উঠলাম রিমন ভাইয়ের বড় ভাইয়ের শ্বশুর বাড়িতে। ঈদের দিন সকালে সেমাই খেয়ে রওনা দিলাম। ইচ্ছা ধামরাই পর্যন্ত যাওয়া। ধামরাই ইশতিয়াক ভাইয়ের বাড়ি। উনি আবার বাড়িতে কিছু না বলেই ট্যুরে বের হয়েছেন। কারণ বললে বের হতে দিত না।

সারাদিন হেঁটে উনাদের বাড়িতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত হয়ে গেল। বাড়িতে ঢুকার আগে ইশতিয়াক ভাই সাবধান করে দিলেন, ‘ভাই আম্মা আমার সঙ্গে চিল্লাফাল্লা করতে পারে, মাইরও দিতে পারে আপনে কিন্তু কিছু মনে কইরেন না।’ ইশতিয়াক বাসায় ঢুইকাই বললেন, ‘বকাঝকা করার আগে একটু সময় দাও।’ আমাকে দেখাইয়া পরিচয় করিয়ে দিলেন। তারপর আমাদের ভ্রমণের কিছু পত্রিকা কার্টিং যেগুলো বের হইছে সেগুলা তাঁর বাবার হাতে দিয়া বললেন, ‘আগে এইগুলা পড় তারপর যত ইচ্ছা বকাঝকা কইর।’ উনারা দুইজনেই পত্রিকায় নিজের ছেলের খবর আর ছবি দেইখা শান্ত হয়ে গেলেন। তেমন কিছুই বললেন না। শুধু উনার আম্মা সামান্য উচ্চবাচ্চ করলেন। ইশতিয়াক ভাইয়ে রুমে ঢুকার পর বললেন, ‘ভাই পত্রিকার নিউজগুলা ভালই কাজে দিছে তা না হলে খবর আছিল। যাই হোক কালকে কিন্তু ভোরে বের হওয়া যাবে না। একটু দেরিতে বের হতে হবে। তাড়াতাড়ি বের হলে, বাসায় চিল্লাফাল্লা শুরু করতে পারে।’ আমিও রাজি হয়ে গেলাম, অন্তত একটা দিন না হয় একটু বেশিই ঘুমাইলাম।

সকালে নাস্তা করে রওনা দিলাম ঢাকায় পৌঁছালাম বিকালের দিকে। বাংলাবান্দা থেকে তেতুঁলিয়া, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, ফুলবাড়ি, বগুরা, টাঙ্গাইল, ধামরাই হয়ে ১২ দিনে পৌঁছালাম ঢাকায়। ঈদের পরের দিন তাই ঢাকাও মোটামুটি ফাঁকা।

ঢাকা ছাড়ার সময় আমাদের কিছুটা পথ হেঁটে সঙ্গ দিলেন জাকির, তুষার ভাই। তুষার ভাই তো নারায়নগঞ্জের সাইনবোর্ড পর্যন্ত সঙ্গে থাকলেন। কুমিল্লার দিকে হেঁটে যাচ্ছি। পাশ দিয়ে এক রিক্সা গেল। কিছুটা যাওয়ার পর রিক্সা থামনো হল। রিক্সায় বসা এক লোক ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলো, ‘হ্যালো ব্রাদার্স হাও আর ইউ?’ আমিও ইশতিয়াক ভাইকে চিমটি দিয়ে ইংরেজিতে উত্তর দেয়া শুরু করলাম। ঐ লোক নানারকম কথাবার্তা জিজ্ঞেস করার পর জিজ্ঞেস করলেন, ‘হোয়ার ইউর কান্ট্রি?’ আমি যখন উত্তরে বাংলাদেশ বললাম। তখন লোকটার চেহারা যে হয়েছিল তা আর বলার মত না। উনাকে বিদায় দিয়ে আমি আর ইশতিয়াক ভাই নিজের অনেক হাসাহাসি করলাম। এখনও সেই দিনের কথা মনে পড়লে একা একাই হেসে উঠি।

কুমিল্লা থেকে চৌদ্দগ্রামের দিকে যাওয়ার পথে হাড়িসর্দার নামে এক বাজারে থামলাম নাস্তা করবো বলে। দোকানে গিয়ে খাবার ও পানিও চাইলাম। লোকটা তো আমাদের কথা শুনে অবাক, ‘অবাক হয়ে বললো আপনারা বাঙ্গালি! আমি তো ভেবেছিলাম আপনারা শ্রীলঙ্কার!’ পরে তাঁর সাথে কথা বলে জানা গেল তাঁর নাসিম। তিনি আমাদের সঙ্গে অনেক্ষণ কথাবার্তা বললেন। নাসিম ভাই শেষ পর্যন্ত আমাদের খাবারের বিলটাও দিতে দিলেন না।

দুইজনে মিলে গল্প করতে করতে ফেনী পার হচ্ছি। উল্টা দিক থেকে আসা এক প্রাইভেটকার আমাদের সামনে থামলো। নানারকম কথাবার্তা বলে বলল, ‘কি লাভ এই সব করে?’ যাওয়ার সময় আবার আমাদের দুইজনকে দুইটা কমলাও দিয়ে গেল।

বারৈয়ার হাটে রুম ভাড়ার জন্য আবাসিক হোটেলে গেলাম। ম্যানেজার কেমন যেন সন্দেহের চোখে তাকালো। আমাদের রুম ভাড়া দিবেই না এমন একটা ভাব, নানা রকম প্রশ্ন। কথায় কথায় বললেন এই প্রোগ্রামে তো পত্রিকায় খবর ছাপায় আপনাদের এমন কিছু আছে ? আমরা পত্রিকার কাটিং দেখালাম বেশ ভালই কাজে দিল। ম্যানেজার আমাদের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলা শুরু করল। আমরা সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে হোটেল ভাড়া কম দিলাম।

বারৈয়ার হাট থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে দূর থেকে দেখতে পারলাম একজন সাইকেল চালিয়ে আসছে। সাইকেল দেখেই আমি উত্তেজিত হয়ে গেলাম। কথায় কথায় ইশতিয়াক ভাইকে বললামও উনি ভ্রমণে বের হয়েছেন। কারণ সাইকেলের পেছনে পেনিয়ার লাগানো, মাথায় হ্যালমেট। কাছে আসতেই থামালাম, কথা বলে জানতে পারলাম তিনি টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া সাইক্লিং করছেন। দেখে ভাল লাগল, আমরা একসঙ্গে ছবি তুললাম। উনার কিছু খাবার-দাবারও লেনাদেনা করলাম।

পুরো পথে বাস-ট্রাক দুমরেমুচরে পরে থাকা অনেক বাস-ট্রাক দেখতে হয়েছিল। কিছু এক্সিডেন্টের রক্তের দাগও শুকায় নাই। এভাবেই হাঁটতে হাঁটতে একদিন পৌঁছে গেলাম বন্দর নগরী চট্টগ্রামে। সেখানে দেখা করলাম চন্দন ভাই, ফয়সাল ভাই, মারুফ ভাই এবং জাফর ভাইয়ের সঙ্গে। জাফর ভাই অবশ্য সবার কাছে মীর জাফর নামেই পরিচিত। তবে কয়েকদিন আগে তিনি বান্দরবান থেকে ঘুরে এসে ফেসবুকে নতুন নাম দিয়েছেন, জাফর ত্রিপুরা। আমরা মোটামুটি নিশ্চিত তিনি বান্দরবানের কোন ত্রিপুরা পাড়ার ত্রিপুরা মেয়ের প্রেমে পরেছেন। তাই এই নাম দিয়েছেন!

রাতে ফয়সাল ভাইয়ের সৌজন্যে জম্পেস খাওয়া হল। খাওয়ার পর প্রথমে ঠিক হল জাফর ভাইয়ের অফিসে থাকব। গেলাম উনার অফিসে, সিড়ি দিয়ে উপরে উঠার সময় পরিচয় ডা. তৈয়ব সিকদারের সঙ্গে। তিনি আমাদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুশি হয়ে আমাদের ভ্রমণে শুভ কামনা জানিয়ে আমাদের কিছু অর্থ দিয়ে সহযোগিতাও করলেন। আমরা জাফর ভাইয়ের অফিসে ঢুকতে পারি নাই শেষ পর্যন্ত। কারণ ভেতরে যে থাকে তিনি দরজা লাগিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। অনেক ডাকাডাকির পরেও তাঁকে তোলা গেল না। তাই বাধ্য হয়ে ফয়সাল ভাইয়ের বাসাতেই আমাদের আশ্রয় নিতে হল। ফয়সাল ভাইয়ের বাসায় যেয়ে আমাদের লাভই হল। উপহার স্বরূপ পেলাম তিনজনে তিনটা টি-শার্ট।

চট্টগ্রাম থেকে রওনা দিয়ে একরাত থাকতে হল লোহাগড়ায় এক আবাসিক হোটেলে। দুইজনের ভাড়া নিল ১২০ টাকা। কিন্তু সারা রাত ছাড়পোকার কামড়ে ঘুমাতে পারলাম না। যেখানে প্রতিদিন ইশতিয়াক ভাই আমাকে ডেকে তুলেন সেখানে ভোরে আমাকে ডাকতে হয় নাই।

কক্সবাজারে আমাদের জায়গা হল টুটু ভাইয়ের বন্ধু তোহা ভাইয়ের হোটেল মার্মেইডে। আমাদের টাকাও প্রায় ফুরিয়ে এসেছিল। মনা ভাই ঢাকা থেকে আমার ব্যাংক একাউন্টে কিছু টাকা পাঠালেন। আমরা বুথ থেকে টাকা তুলে নিলাম। যে টাকা পেলাম তা দিয়ে অন্তত টেকনাফে গিয়ে ভ্রমণ শেষ করতে পারব। মনা ভাই আর বাবু ভাই ঢাকা থেকে টেকনাফে আমাদের সঙ্গে যোগ দিবেন। শেষ দিন উনারা আমাদের সঙ্গে থাকবেন তাই আর টাকা নিয়া চিন্তা নাই। শুধু আমাদের ভবিষ্যত ২/৩ দিন হিসেব করে খরচ করতে হবে।

সকালে আমরা হাঁটা শুরু করলাম বীচ ধরে। কিছুক্ষণ পরেই একপাশে সমুদ্র অন্য পাশে পাহাড় শুরু হল। কিন্তু এত বেশি ট্যুরিস্ট বেশি ভাল লাগল না। সন্ধ্যার দিকে ইনানী পৌঁছালাম। আমাদের ইচ্ছা তাঁবুতে থাকা, কারণ ইনানীর হোটেলগুলোতে খরচ একটু বেশি আর আমাদের টাকাও কম। ইনানী পিকনিক স্পটে গেলাম, তাদের খোলা জায়গায় তাঁবু পিচ করার জন্য। আমাদের তাঁবু পিচ করতে দিল না। বললো এখানে পিচ করা যাবে না। হোটেল ভাড়াও অনেক বেশি, ১ হাজারের মত। আমরা সব কিছু খুলে বলার পর কেয়ারটেকার মালিকের সাথে কথা বলে আমাদের হোটেলেই থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। কোন টাকা নিল না।

পরের দিনটা ছিল আরো ভাল। কোন রকম ট্যুরিস্ট নাই, শুধু জেলেরা মাছ ধরছে। তাঁদের সঙ্গে ইশতিয়াক ভাই কিছুক্ষণ জালও টানলেন। বিকালে পৌঁছালাম শিলখালি। থাকার ব্যবস্থা হল ইউনিয়ন পরিষদের একটা রুমে। সেখানে পৌঁছে ইশতিয়াক ভাইয়ের আর তর সইছিল না। আমাকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেলেন সমুদ্রে। সমুদ্রের পাশ দিয়ে যাচ্ছি আর সমুদ্রে স্নান না করলে হয়! শিলখালিতে রাতের খাওয়া-দাওয়া করলাম মোহাম্মদ আলীর বাসায়। মোহাম্মদ আলী এখানকার স্থানীয় বাসিন্দা সিএনজি চালায়।

২৫তম দিন পৌঁছালাম টেকনাফে। তখন বাজে দুপুর ২ টার মতো। চাইলে এইদিন পৌঁছে যেতে পারতাম আমাদের বাংলাদেশের শেষ সীমানায়। কিন্তু পরের দিন মনা ভাই আর বাবু ভাই আসতেছেন। বাবু ভাই প্রথম দিনও ছিলেন ছিলেন শেষ দিনও থাকার জন্য ছুটে আসছেন ঢাকা থেকে। তাই ঐদিন টেকনাফে থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। হোটেল ভাড়া দেয়ার পর দেখা গেল আমাদের হাতে বাস ভাড়া ছাড়া আর কোন টাকা নেই। তাই ঠিক করলাম রাতের খাবারটা সঙ্গে থাকা বিস্কুট দিয়েই চালিয়ে দিব।

টেকনাফে অনেকটা আচমকাই আমাদের সাথে দেখা হয়ে গেলো মসিউর ভাইয়ের সঙ্গে। ভাইয়া আমাদের রাতে তাঁর সঙ্গে খাওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন। আমরাও খুশি তাঁর অনুরোধে। সারাদিন কোন কাজ নেই। তাঁর সঙ্গে আমরা দুইজন ঘুরাফেরা করলাম, খাওয়া দাওয়া করলাম।

পরদিন সকালে মনা ভাই ও বাবু ভাই আসার পর রওনা দিলাম আমাদের শেষ গন্তব্যে। আমরা শাহ্পরীদ্বিপে পৌঁছে কিছু যেটির শেষ প্রান্তে যেয়ে কিছু সময় কাটালাম ছবি তুললাম। কিছুক্ষণের মধ্যে মশিউর ভাইও সিএনজিতে এসে আমাদের সঙ্গে দুপুরে যোগ দিলেন। আমরা এক সঙ্গে দুপুরে খেলাম।

ছবি: মীর শামছুল আলম বাবু (সম্ভবত)

চলে গেলাম বদরেমোকাম বাংলাদেশের শেষ সীমানায়। এক ধরনের আনন্দ হচ্ছিল ভ্রমণ শেষ হওয়ার আনন্দে আবার অনেক বেশি মনও খারাপ হচ্ছিল শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে। পুরা ২৬টা দিন এক সঙ্গে ছিলাম, একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরলাম।

কালের কণ্ঠ, ২৭ ডিসেম্বর ২০১০
ডেসটিনি, ১ জানুয়ারি ২০১১
ভ্রমণ কথামালা ২

Comments

comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.