এই বছরের প্রথম ট্যুর (২০১২)। একজন বিদেশিকে নিয়ে যেতে হবে পুরান ঢাকার কয়েকটি জায়গা দেখানোর জন্য। নাম তাঁর মায়া। হারবার্ড ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের অধ্যাপক, বয়স ৩৭ এর মত হবে। একসময় তাঁর দাদা এই দেশে থাকতেন। তিনি কোথায় পড়শোনা করেছেন, কোথায় থাকতেন এইসব দেখার জন্য সুদূর আমেরিকা থেকে উড়ে এসেছেন এই দেশে। যাত্রীক ট্র্যাভেলার্স এই ট্যুরের আয়োজন করেছে। তাঁর সঙ্গী হিসেবে থাকার এবং ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সবকিছু দেখানোর দায়িত্ব পড়লো আমার আর রাহাত ভাইয়ের উপর। মশিউর ভাইয়ের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে আমি আগের দিনই একবার দেখে এসেছি কোথায় কোথায় নিয়ে যেতে হবে। কয়েকটি জায়গা পেলেও একটি জায়গা কোথাও খুঁজে পাইনি না। কারণ তাঁরা যখন থাকতেন এই এলাকায় সেটা ১৯৩০ সালের আগের ঘটনা। প্রায় একশ বছরের কাছাকাছি সময় পরে এসে সেইসব জায়গা খোঁজা মানে, খড়ের গোদায় সুই খোঁজার মতই ব্যাপার।
সকালে রওনা দিলাম ৮ টার দিকে রাহাত ভাই আগেই গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিল আমার জন্য সংসদ ভবনের সামনে। সেখান থেকে সোজা গুলশান, গুলশান থেকে মায়াকে তুলে নিয়ে রওনা দিলাম পুরান ঢাকার উদ্দেশে। প্রথমেই পৌঁলাম লক্ষ্মীবাজার, আমরা ঢুকবো সেন্ট গ্রেগোরি স্কুলে, এই স্কুলে মায়ার দাদা লেখাপড়া করেছেন, তাও আবার ১৯৩২ সালের দিকে। আর এই স্কুলের জন্ম ১৮৮২ সালে। আমরা ঢুকে পুরোনো বিল্ডিংটা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। সঙ্গে গাইড হিসাবে পেয়ে গেলাম সেন্ট গ্রেগরি স্কুলেরই ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র মারিন। মারিন চমৎকার ইংরেজি বলে। নিচতলায় ঢুকে প্রথমেই পড়ল বিশাল একটা রুম, দেয়ালে টানানো কয়েকজনের ছবি। যাঁরা প্রথমে এই স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন এবং স্কুলটিকে চালিয়েছেন তাঁদের ছবি। বড় রুমে দুই দিক দিয়ে কয়েকটি ছোট ছোট ক্লাসরুম। দ্বিতীয় তলায় উঠার সিড়ি দেখে মনে হয় যে কোন সময় ভেঙ্গে যেতে পারে। কিন্তু উপরে উঠার পর সিড়িই বলে দিলো ‘আমি এখনো শেষ হয়ে যায়নি’। দ্বিতীয় তলায় গির্জা, দুই-একটি রুম তালা মারা ভেতরে কি আছে দেখার উপায় নেই। পুরাতন স্কুল দেখে বের হয়ে আসলাম, পাসেই নুতন ভবন বর্তমানে এখানে সব ক্লাস হয়ে থাকে। নতুন ভবনটি পুরনো ভবনের কাছে বেমানান। মারিনকে বিদায় দিয়ে চলে গেলাম সুভাস চন্দ্র বসু এভিনিউ রোডের ৬১/১ নাম্বার বাড়িতে।
এই বাড়িতেই মায়ার দাদারা বসবাস করতেন। নিচ তলায় প্রেস ও হিসাব বিভাগ। সেখানে এক খ্রিষ্টান মহিলাকে পাওয়া গেল যিনি পুরো অফিসের কার্যক্রম সমন্বয় করে থাকেন। দ্বিতীয় তলায় খাবারের ঘর, প্রার্থণার ঘর ও অফিসের কার্যক্রমের জন্য একটি রুম। এই রুমে বসেন পরিচালক ফাদার জয়ন্ত এস. গমেজ। এই রুমেই মায়ার দাদা পড়াশোনা করতেন মায়ার কাছ থেকেই যানা গেল। তৃতীয় তলায় দুই/তিনটি অফিস রুম। অফিসে পরিচয় হলো এক সিস্টারের নাম মালতি কস্তা, তিনিও এখানে সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আরেক রুমে ঢুকে আমি আর রাহাত ভাই পুরোপুরি তাজ্জব হয়ে গেলাম। তৃতীয় তলার সেই রুমে স্টুডিও বানিয়ে রেখেছে তাঁরা। এখান থেকে খ্রীষ্ট ধর্মীয় বাংলায় রেডিও প্রোগ্রাম প্রচার করা হয়। নাম দেয়া হয়েছে রেডিও ভেরিতাস এশিয়া, বাংলা বিভাগ, ফিলিপাইন। তার মানে রেডিওর প্রোগ্রামগুলো প্রচার হয় ফিলিপাইনে। ভেরিতাস শব্দের অর্থ ‘সত্য’।
শুধু তাই নয় এই ভবন থেকে প্রতি সপ্তাহে একটি পত্রিকা বের হয়, নাম প্রতিবেশি। নীচ তলায় দোকান আছে যেই দোকানে ধর্মীয় জিনিশ-পত্র ও প্রকাশনা পাওয়া যায়। প্রকাশনার মধ্যে একটি ডিকটেটরি পাওয়া যায় যেই ডিকটেটরিতে বাংলাদেশে কোন জেলায় কোন গীর্জায় কোন ফাদার দায়িত্বে আছে তার তালিকা এবং ঠিকানা। পুরোটাই একটা চেইনের মাধ্যমে যাচ্ছে। আরো একটা তথ্য পাওয়া গেল দেশের যত মিশনারিজদের অধিনে যেই স্কুলগুলো আছে সব স্কুলের পরিক্ষার খাতা থেকে শুরু করে অনেক কিছু এখান থেকেই তৈরি হয়। শুধু তাই নয় বেশির ভাগ প্রকাশনাও এখান থেকেই বের হয়।
আমাদের পরবর্তী টার্গেট বানার্জী জমিদার বাড়ি। বানার্জী জমিদার বাড়ির আসেপাশে কোন বাড়িতে থাকতেন মায়ার নানারা। তাঁদের পরিবারের টাইটেল ছিল গুপ্তা পরিবার। এই নামে কোন পরিবার বা তাঁদের বাড়ির কোন খোঁজ গতকাল আমি খুঁজে পাইনি এবং আজকেও পাব না, সেটাও জানি। তবে মায়ার লোকেশন মত সেই জায়গাটা দেখানোর জন্য যেতে হলো সুত্রাপুর বাজারের কাছে। লোকেশনটা ছিল সুত্রাপুরে একটি লেক আছে। লেকের পাশেই একটি জমিদার বাড়ি, লোকজনের কাছে বানার্জী জমিদার বাড়ি নামে পরিচিত। জগতের সবচেয়ে কঠিন কাজ এটা। এই কঠিন কাজটা গতকালই করে ফেলেছি এবং তথ্য মতে সুত্রাপুরে আগে একটি খাল ছিল ঠিক। কিন্তু এখন সেই খালের উপর রাস্তা তৈরি হয়েছে। সেই রাস্তার পাশে একটি বড় জমিদার বাড়ি আছে। কিন্তু সেটা বানার্জী জমিদার বাড়ি না। স্থানীয় বয়স্ক লোকদের কাছ থেকে তথ্য পেলাম এই বাড়িটি যাদের ছিল তাদের নাম সুতু বাবু, উতু বাবু নামে পরিচিত। বর্তমানে বাড়িটি সিভিল ডিফেন্সের কলোনী হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
যথারীতি তথ্য অনুযায়ী কোন কিছুই পেলাম না তবে মায়ার কয়েকটি পুরনো বাড়ি দেখার ইচ্ছা ছিলো। তাঁর ইচ্ছামত আমরা বিকে দাস রোডে কিছু পুরনো বাড়ি দেখালাম। সেখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে নারিন্দায় চলে গেলাম। সেখানে ঢুকলাম খ্রিস্টানদের কবরস্থানে, ভেতরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটি কুকুর ঘেঁউ ঘেঁউ শুরু করে দিল। ‘যেন প্রশ্ন করছে এখানে তোমরা কি করো’। কিছুক্ষণ পর তাদের চিল্লাচিল্লি এমনিতেই থেকে গেলো। মনে হয় ক্লান্ত হয়ে গেছে।
এই করবস্থানে এর আগে একবার এসেছিলাম। ভেতরে অনেকগুলো কবর আছে, কবরের ফলকে নাম, জন্ম ও মৃত্যু তারিখ দেওয়া। শুনশান নিরব, কোন সারাশব্দ তেমন পাওয়া গেল না, শুধু কয়েকটি পাখির ডাকাডাকি। দুপুর হওয়াতে বাইরে গাড়িও কম তাই গাড়ির শব্দও তেমন শোনা গেল না। মায়া এখানে বেশ কিছু ছবি তুলে নিল, সঙ্গে আমরাও কয়েকটি ছবি তুলে নিলাম।
কবরস্থান থেকে বের হয়ে ধোলাই খালের দিকে রওনা দিলাম। সেখানে আমাদের ড্রাইভারকে ফোন করে আসতে বলে দিলেন রাহাত ভাই। আমরা প্রায় সকাল থেকে হেঁটেই চলেছি, ঘড়িতে প্রায় তিনটার মতো বাজে। ধোলাই খালের কাছে একটি ওয়ার্কসপে ঢুকে লোহা গলিয়ে ডাইস বানানো দেখে নিলাম। এভাবে যে শুধু একটি দোকানে ওপেন ডাইস বানানো যায় সেটা মায়া আশা করেনি। বের হয়ে এই নিয়ে কিছু আলোচনাও জুরে দিলো আমাদের সঙ্গে, ‘এঁরা কতো বিপজ্জনক ভাবে কাজ করে!’ মায়াদের দেশে নিশ্চয় কলকারখানার জন্য আলাদা এলাকা আছে, তাই এইরকম অবাক হচ্ছে।
দুপুরে খেতে বসলাম এক হোটেলে, আমরা দুইজনে বিরানী আর মায়া শুধু রুটি আর সবজি খেল। খাওয়া শেষ করে সোজা সদরঘাট। টিকেট কেটে টার্মিনালে ঢুকলাম, দেশের দক্ষিণের বেশির ভাগ লঞ্চ এখান থেকে ছেড়ে যায়। অনেক লঞ্চ দাড়িয়ে আছে, লোকজন চিৎকার করে জানান দিচ্ছে কোন লঞ্চ কোথায় যাবে। জেটির মাঝখানে কিছু জায়গা খালি রেখেছে কর্তৃপক্ষ। কিছুক্ষণ পর পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. দিপু মনি আসছেন লঞ্চে করে, তাই এই ব্যবস্থা। যেখানেই যাচ্ছি লোকজন আমাদের দেখে ঘিরে ধরছে, আমাদের দেখার জন্য। কেউ কেউ আবার আমাকেও ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করছে, ভাবছে আমিও দেশের ভাইরে থেকে এসেছি। পরে এটা নিয়ে মায়া ভালই মজা পেয়েছে।
সদরঘাট দেখার পর গেলাম আহসান মঞ্জিল দেখতে। ঘড়িতে ৪.৩০ টা বাজে আহসান মঞ্জিল বন্ধ হয়ে গেছে, তবুও মায়া যেতে চাইলে বাইরে থেকে দেখার জন্য। গেলাম আহসান মঞ্জিলে যেখান দিয়ে ঢুকে সেইখানে গাড়ি রেখে আমরা চলে গেলাম একদম বাড়ির সামনের দিকে নদীর পারে যেটাকে বলা হয় নবাব বাড়ি ঘাট।
আহসান মঞ্জিল থেকে রওনা দিলাম আমাদের নতুন ঢাকার দিকে। পুরনো ঢাকার ভয়াবহ জ্যাম থেকে মুক্তি পেয়ে নতুন ঢাকায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল। সারাটা দিন ভালোই কাটলো পুরনো বাড়িঘর নিদর্শন দেখতে।




