পথের খোঁজে পথে আসা এই আমি!

36675_1469045216006_7948799_n

কেন জানি আমার সব কিছুই একটু উল্টাপাল্টা। এই যেমন, কোন কারণে মায়ের চাইতে বাবাকেই বেশি ভাল লাগত। মাকে খুব একটা পছন্দ করতাম না। তবে মার সঙ্গে একটা বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক ছিল, নানা রকম বিষয় নিয়া কথা বলতাম সেই অল্প বয়সেই। নানা রকম প্রশ্ন করে জর্জরিত করতাম। এমনিতে আমি খুব বেশি চুপচাপ ছিলাম। সেই চুপচাপের মধ্যে খুব ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ার মতো প্রশ্ন করতাম।

বাবাকে খুব বেশি বাসায় পেতাম না। বাবা প্রতিদিন খুব বেশি ভোরে বের হয়ে যেতেন আর ফিরতেন রাত ১১টা বা ১২ টার পরে তখন আমরা ঘুমে থাকতাম। বিশেষ করে যখন ৫/৬ বছর বয়স তখনই এই ঘটনা বেশি ঘটত। যাওয়ার সময় দুই ভাইয়ের বালিশের নিচে দুই টাকা করে রেখে যেতেন। কোন কোন সপ্তাহে সন্ধ্যায় আসতেন তখন আমাদের দুই ভাইয়ের বেশ আনন্দ হতো। কারণ বাবার সঙ্গে বাজারে যাওয়া যেত। বাজারে যাওয়াটা কেন জানি খুব আনন্দের ছিল। সেই সময়টা ছিল আমাদের পরিবারের স্বর্ণযুগ। সারাদিন বাসায় আত্মীয়স্বজনের আনাগোনা লেগেই থাকত।

বাবা বিয়ে করেছিলেন মোটামুটি অল্প বয়সে ১৬/১৭ বছর বয়সে। তখন আমার মায়ের বয়স সাত। এই সব গল্প মার কাছ থেকেই শোনা। বাবার যখন বয়স ২৪/২৫ বছর বয়স বাবা মাকে রেখে চলে গেলেন। ৩/৪ বছর পর ফিরে আসলেন ভারত/পাকিস্তান নানা জায়গায় ঘোরাফেরা করে। আমার বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের অবস্থাও আস্তে আস্তে খারাপ হতে শুরু করল। তখন বাবার ব্যবসার কাজে আমরা সবাই অল্প অল্প সহযোগিতা করি। বিশেষ করে মাকে ঘর সামলানোর পরেও ব্যাবসার কাজের জন্য বাইরে যেতে হত। সব সময় সঙ্গী থাকতাম আমি। প্রায় এক বছর মার সঙ্গে পুরান ঢাকার চক বাজার, বেগম বাজার, নয়া বাজার আর মিটফোর্ড যেতে হতো প্রতি সপ্তাহে।

আমি তখন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি। বৃহস্পতিবারে হাফ ক্লাশ। দুপুর দুই টায় ছুটি। বাবা বিকালে চারটার দিকে ফিরে এসে আমার হাতে টাকা ধরিয়ে দিয়ে বললেন নয়া বাজার যাও। এই টাকা দিয়ে কাগজ কিনে আনো। তখন আমার বয়স কতইবা হবে? নয় অথবা দশ! বাবার কথা শুনে মা সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করলেন, ‘ও এখনো ছোট এখনি একা একা এতদূর কিভাবে যাবে?’ বাবাও স্বাভাবিকভাবে উত্তর দিলেন, ‘কোন কিছু শিখতে হলে অল্প বয়স থেকেই শিখতে হয়।’ বাবা প্রথম বারের মতো বাইরের দুনিয়ায় আমাকে একা ছেড়ে দিলেন। তখন বেশ আনন্দ হয়েছিল, নিজেকে বেশ বড় বড় মনে হয়েছিল। সেটা ছিল আমার বড় হওয়ার পেছনে একটা ধাক্কা। আরো বড় ধাক্কা আসলো সেই ঘটনার ছয়/সাত বছর পর।

তখন মা মারা গেছে। মা মারা যাওয়ার বছর খানেক পর বাবা আমাদের দুই ভাইকে রেখে চলে গেলেন। তখন মনে হচ্ছিল আমি মনে হয় সত্যি সত্যি বড় হয়ে গেছি। প্রথম দুই/তিন মাস বাড়ি থেকে টাকা আসল। বেশ ভাল টাকাই আসল বাড়ি ভাড়া দিয়ে খেয়েদেয়ে দুই ভাইয়ের ভালই চলছিল। হঠাৎ একদিন বাবা বললেন, ‘আমার বয়স হয়েছে এখন আর আমি তোমাদের আগের মত টাকা পয়সা দিতে পারবো না। তোমাদের রাস্তা এখন তোমাদেরই দেখতে হবে।’ আমরা দুই ভাই তখন অতল সমুদ্রে এসে পড়লাম। একদিকে আমরা পুরাপুরি স্বাধীন আমাদের কাউকে কারও কিছু বলার নাই। যেদিকে ইচ্ছা সেদিকে যেতে পারি, নিজের ইচ্ছা মত সিদ্ধান্ত নিতে পারি। কিন্তু এই স্বাধীনতায় এক ধরনের অদ্ভুত শূন্যতা। মনে মনে পরাধীনতা খুঁজি। সেই সময়টায় নতুন করে আবিষ্কার করলাম আসলে মা-ই আমাদের জন্য বেশি চিন্তা করতো। আস্তে আস্তে মাকেও অনুভব করতে থাকলাম। মাকেও নতুন করে ভালোবাসতে শুরু করলাম।

বাবা আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়ার পর। এক ধরনের অভিমান থেকে বাবার সঙ্গে কথা বলা অনেক কমিয়ে দিলাম। চলে যাওয়ার পর যে কয়েকদিন টাকা দিয়েছে প্রতিবার ছোট ভাই যেয়ে টাকা নিয়ে আসত। আমি কোনদিন বাবার কাছ থেকে টাকা নেই নাই। চাকরী পাওয়ার পর কথা কমাতে কমাতে এক সময় কথা বলা বন্ধই করে দিলাম। ছোট ভাই মাঝে মাঝে বাবার কাছে যেত আমি টাকা দিয়ে দিতাম। ছোট ভাইয়ের মোবাইলের মাধ্যমে অনেকদিন পর একদিন বাবার সঙ্গে কথা হলো। বাবা বললেন, ‘আমার তো বয়স হইতেছে মাঝে মাঝে একবার দেখা করে যাইও।’ আমি কেন কথা কমিয়ে দিয়েছিলাম কেন কথা বলি নাই বাবা কোনদিন জিজ্ঞেস করে নাই। একদিন গেলাম বাবার সঙ্গে দেখা করতে। আস্তে আস্তে আবার সব স্বাভাবিক হয়ে গেল। বাবাকে একসময় একটা মোবাইল কিনে দিলাম।

তবে এখন বুঝতে পারি, সেই চতুর্থ শ্রেণিতে বাইরের দুনিয়ায় বের করে দিয়ে কতটা উপকার করেছিলেন। সেই ১৭/১৮ বছর আগে পথে ছুড়ে দিয়ে ভালই করেছিলেন। আজ আমার আমি তৈরি হয়েছি ঐ পথ থেকেই। পথে না পড়লে হয়তো স্রোতের সঙ্গে হারিয়ে যেতাম…

৭ আষাঢ় ১৪২২

Comments

comments

Comments

  1. ভালোবাসায় জড়ানো সুকঠিন বাস্তব..। এই শব্দগুলোর ভেতরকার আন্তরিকতা, কষ্ট, অভিমান কোনকিছুই সঠিকভাবে অনুভবের ক্ষমতা আমার নেই। তবে, মনে করি, বাবার সেইদিনের সেই বৃহৎ জীবনের পথে ঠেলে দেয়াটাই ছিলো আপনার জীবনের এতোটা পথ পাড়ি দেয়ার পেছনের অলক্ষ্যের কারিগর..। এইযে আপনি সাইকেলে ছুটে চলছেন হাজার হাজার মাইল, পায়ে হেঁটে ছুঁয়ে চলেছেন একটার পর একটা জিরো পয়েন্ট, এইসব কিছুর পেছনে নেপথ্যে বেঁচে আছেন বাবা..। ভালোবাসা রেখে যাচ্ছি বাবার জন্য। শুভ কামনা রইলো আপনার জন্য। জীবনের পথে আপনার এই ভ্রমণ যেনো কখনোই শেষ না হয়..। ভালো থাকবেন ভাই..।

    1. ঠিক ভাই।

      1. হুম 🙂

  2. পাথুরে বিষাদ

    শরীফ ভাই, মন ছুঁয়ে গেল লেখাটা। ভালো থাকবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.