প্রতিভা: মোহাম্মদ ইসমাইল মিয়া

মানিক
মানিক

আমার পুরনো সমবয়সী বন্ধুর সংখ্যা বর্তমানে অনেক কম। বেশির ভাগ বন্ধুগুলাই কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। বর্তমানে যা আছে তাও হাতে গোনা কয়েকজন। এই হাতেগোনা কয়েকজনের মধ্যে একটু অন্যরকম প্রতিভা আছে এমন সংখ্যা এক/দুইয়ের বেশি না। সেই এক দুইজনের মানিক একজন। মানিকের পুরা নাম মোহাম্মাদ ইসলমাইল মিয়া। আমাদের কাছে মানিক নামেই পরিচিত।

মানিকের সঙ্গে পরিচয় হয় লুলু স্যারের বাসা। স্যারের আসল নাম এনামুল হক ক্যামনে লুলু নাম হল জানা নাই। আমি আমার জীবনে স্কুলের বাইরে একটা স্যারের কাছেই পড়েছি। সেই স্যারের বাসায় পড়তে যেয়েই মানিকের সঙ্গে পরিচয়। স্যারের বাসায় সবাই অপরিচিত ছিল সুধু শাকিল ছাড়া। আমি আর শাকিল একসময় একসঙ্গে পড়তাম। ততদিনে আমি ব্যাকব্যাঞ্চ থেকে ব্যাক ক্লাসে। আস্তে আস্তে সবার সঙ্গেই পরিচয় হয়ে যায়। মানিক, রুবেলসহ আরো অনেকে। অনেকের মধ্যে এখনও পর্যন্ত মানিক, রুবেল আর এমদাদের সঙ্গেই বন্ধুত্ব টিকে আছে।

মানিকের বাসা ছিল যে এলাকাটায় সে এলাকার নাম প্রেম নগর। এলাকাটা অনেক নীরব থাকত বলেই হয়তো এলাকার নাম প্রেম নগর। আমার বাসা ছিল এগার নাম্বার গলিতে। আমি প্রায়ই মানিকের বাসায় যেতাম। আমাদের দুইজনের মধ্যে একটা জিনিশ বেশ আদান-প্রদান চলত। সেটা হল গানের সিডি। আমরা দুইজনেই গান শুনতাম সিডি রুমে আর নিজেদের হাতে তৈরি সাউন্ড সিস্টেম দিয়ে। কোন কিছু একটু সমস্যা হলেই দুইজনে মিলে সেটা খুলে ফেলতাম।

কয়েকটা জিনিশ ছাড়া আমাদের মাঝে পার্থক্য ছিল বিস্তর। যেমন, মানিক স্কুল স্যারের বাসা আর নিজের বাসা ছাড়া আর তেমন কিছু চিনত না। আর আমি ঐ বয়সে ঢাকার অর্ধেক চিনি, স্কুল পালিয়ে ট্রেনের ছাদে করে নরসিংদী যাই। মানিকদের এসএসসি পরিক্ষার পর ওদেরকে নিয়ে পুরান ঢাকায় ঘুরতে গিয়েছিলাম। ঐটাই ছিল সম্ভবত মানিকের একা একা অথবা বন্ধুদের সাথে বাইরে বের হওয়া।

আমরা তিন বন্ধু, রুবেল, মানিক আর আমি।
আমরা তিন বন্ধু, রুবেল, মানিক আর আমি।

স্কুলে থাকা অবস্থাতেই আমাদের গান শোনার ক্ষেত্রে রুচি ছিল এক রকম। বিশেষ করে আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যান্ড। বাংলা ব্যান্ড থেকে শুরু করে এ.আর.রহমানের কম্পোজিশন, ব্যাকস্ট্রিট বয়েজের গান, ওয়েস্ট লাইফ বলতে পাগল আমরা। তখন আমরা ব্যাকস্ট্রিট বয়েজ আর ওয়েস্ট লাইফের কয়েকটা গান অনুবাদও করে ফেলেছিলাম। অনুবাদের মূল কাজটি মানিকই করছিল। মানিক সুন্দর ছবিও আঁকতো বিশেষ করে কার্টুন।

কোত্থেকে যেন একটা গিটার যোগাড় করে দুই/তিনটা গানের সুরও তুলে ফেলল। যদিও পুরাপুরি গিটার শেখা হয় নাই। একদিন গান একটা লিখে সেটার সুরও দিল। গানটার নাম ছিল সম্ভবত ‘অচীন পুর’। বেশ ভাল কবিতাও লিখত, আমি গেলেই কবিতা দেখাইত আমি মুগ্ধ হয়ে পড়তাম। একসময় বিজ্ঞান বিভাগে স্কুল পাশ করে বাংলা কলেজে ভর্তি কলেজে গিয়ে ভর্তি হল বাণিজ্য বিভাগে। সেখান থেকে পাস করে ভর্তি হল তিতুমির কলেজে। কেন জানি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরমও কিনল না। অথচ চারুকলায় ভর্তি হলে, অনেক ভাল করতে পারত। হয়ত ইচ্ছাও ছিল কিন্তু পরিবারের যাতাকলে সেই ইচ্ছাকে কবর দিতে হয়েছিল।

মানিক ইন্টারে থাকা অবস্থাতেই আমরা প্রায়ই কম্পিউটার মেলায় যেতাম। নতুন নতুন কম্পিউটার দেখতাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার পর রুবেল কম্পিউটার কিনল। ডিজাইন শেখার জন্য একটা বইও কিনল। শেষ পর্যন্ত রুবেলের কিছুই শেখা হল না মাঝখান থেকে মানিক সেই বই দেখে আর ইন্টারনেট থেকে ইলাস্ট্রেটর ফটোশপ শিখে ফেলল। আমাদের হাঁটার ট্যুরের জন্য টি-শার্টের ডিজাইন আরো কিছু কাজও করে দিয়েছিল।

মানিকের করা একটা ডিজাইন
মানিকের করা একটা ডিজাইন

আমাদের মধ্যে প্রায়ই বিভিন্ন মুভি নিয়ে কথা হত, বিশেষ করে কোন ভাল মুভি দেখলেই মানিক আমাকে দিত আমিও দিতাম। একদিন দুইজনে মিলে শিরোনামহীনের একা গানের একটা মিউজিক ভিডিও বানাইয়া ফেললাম মোবাইলে। ছোট ক্যামেরা নিয়ে আমরা ছবি তোলারও চেষ্টা করতাম।

দুই/একদিন আগে মানিকের স্ট্যাটাস দেখলাম। স্ট্যাটাসটা এমন, ‘প্রায় দুই/আড়াই মাস পর একটা মুভি দেখলাম’। অর্থাৎ কর্পরেট চাকুরী আর এমবিএর যাতাকলে সকল প্রতিভা এখন কফিনে আছে। শেষ পেরাক ঠুকার বাকি। এখন দেখার বিষয় কফিনে শেষ পেরাকটা ঢুকবে নাকি কফিন ভেঙ্গেচুড়ে বের হয়ে আসতে পারবে!

২৫ ভাদ্র ১৪২১

Comments

comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.