তখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি। পরিবারের হাজার রকম সমস্যার মধ্যেও স্কুলে ভর্তি হয়েছি। পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছি তাও এক বছর গ্যাপ দিয়ে। বন্ধুরা সবাই ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। ক্লাসের কেউ ভাই বলে না, সবাই তুই তুই করে বলে। অথচ দুই বছর আগেই এরা সবাই ভাই ভাই করে বলতো। স্কুলে যেতে প্রচণ্ড খারাপ লাগে। মূল কারণ সহপাঠিরা সবাই তুই তুই করে বলে। এটা আমার জন্য মেনে নেয়া কঠিন।
আমাদের এগারো নাম্বার গলিতে একটা ছেলে থাকতো নাম মাহাবুব। মাহাবুবও পড়তো আমার সঙ্গেই অর্থাৎ পঞ্চম শ্রেণিতে। মাহাবুবকে সবাই ভাই ভাই করেই বলতো। শুধু পঞ্চম শ্রেণির ছেলেপেলে না ষষ্ঠ শ্রেণির ছেলেরাও ওকে ভাই ভাই করে বলতো। এর মূল কারণ মাহবুব কোন ক্লাসই ঠিক মতো পাশ করতে পারে না। ফেল করতে করতে আজকে এই অবস্থা। মাহাবুবের এতোদিনে অষ্টম শ্রেণিতে থাকার কথা। মাহাবুবের সঙ্গে মেশা শুরু করলাম। ওর সঙ্গে ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেলো, একসময়। ওর সঙ্গে থাকলে ওর ভাষায় ‘খারাপ’ হতে হবে।
খারাপ হওয়ার মানে কি জিজ্ঞেস করাতে সে উত্তর দিতো, ‘আমি যা যা করবো তুইও তাই তাই করবি।’ আমিও তাতে রাজি। শুরু হলো আমার খারাপ হওয়া। সবে-বরাতে মহারাজের দোকান থেকে মসলা এনে মরিচা বানানো। সেই মরিচা বিক্রি করে টাকা কামানো। অনর্থক পোলাপাইনদের মাইর দেয়া, ছেলেপেলেদের পকেট থেকে দুই টাকা ছিনিয়ে নেয়া। এই ছিলো আমাদের প্রধান কাজ। আরও কাজ ছিলো পাগলারপুলে আড্ডা দেয়া। সারাবছর স্কুল পালানো ছিলো নিত্য দিনের ঘটনা। এখনো মনে আছে সেই বছরে মাত্র বারো দিন স্কুলে গিয়েছিলাম। যেখানে সবাই সারাবছরে বারো দিন অনুপস্থিত থাকে সেখানে আমরা ক্লাসে বারো দিন উপস্থিত।
একদিন মাহাবুব এসে বললো, ‘দোস্ত আগামী সপ্তাহে স্কুল পালিয়ে ছবি দেখতে যাবো, রেডি থাকিস।’ আমি রাজি না, কারণ ছবি দেখতে যাওয়া মানে প্রায় পঞ্চাশ টাকার মতো খরচ। এতো টাকা পাবো কই! মাহবুবের ঝারি, ‘আরে হয়ে যাবে, তুই তো প্রতিদিন বাজার করিস, কিছু টাকা মারবি।’ হিসাব করে দেখলাম পঞ্চাশ টাকা যোগাড় করা কঠিন। মাহবুব সায় দিলো, ‘আমরা তো আছি।’
সব ঠিকঠাক হলো, আমরা তিনজন যাবো। মাহাবুব, বাবলু আর আমি। মাহাবুবের বাবার গ্যারেজ ছিলো। বাবলুর বাবার ফার্মেসী। সারা সপ্তাহে বাজার থেকে মাত্র পনেরো টাকা মারতে পারছি। আর একদিন বাপের পকেট থেকে দশ টাকা চুরি করলাম। সব মিলাইয়া আমি পঁচিশ টাকা। তখন পঁচিশ টাকা মানে অনেক টাকা সম্ভবত পনেরো টাকায় এক কেজি চাল পাওয়া যেতো।
যাই হোক আমি পঁচিশ টাকা, মাহাবুব চল্লিশ টাকার মতো যোগাড় করতে পারছে। আর বাবলু আমাদের থেকে কয়েক ডিগ্রি উপরে। সে তাঁর বাবার ক্যাশ থেকে একশ টাকার একটা নোট গায়েব করে দিছে। সব ঠিকঠাক হলো আমরা গুলিস্তান হলে যাব ছবি দেখতে। এক টিকিটে দুই ছবি। উত্তেজনায় রাতে ঘুম হয় নাই। আমরা দেখবো বারোটার শো। কারণ আমাদের স্কুল শুরু হয় সাড়ে এগারোটায় ছুটি দেয় বিকাল সাড়ে চারটায়। এর মধ্যেই আমাদের ছবি দেখে ফিরে আসতে হবে। নাখালপাড়া থেকে গুলিস্তান অনেক দূর।
এগারোটার দিকে বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম। তিনজনেরই স্কুলের পোষাক আমরা হেঁটে হেঁটে ফার্মগেট গেলাম। পথে তিনজনেই ব্যাগে করে গেঞ্জি নিয়ে এসেছিলাম, সেগুলা পাল্টে ফেললাম। ফার্মগেট থেকে বাসে গুলিস্তান। একেকজনের ভাড়া দুই টাকা করে। তিনজনের মধ্যে মাহাবুব বেশি এক্সপার্ট, ওকে দেখতেও একটু বড় বড় লাগে। আমি আগে কখনো হলে ঢুকিনি তার উপর দেখতে যাচ্ছি ইংলিশ ছবি। ইংলিশ ছবি মানেই খারাপ ছবি। হলের কাছে যাইয়া পোস্টার দেখে মাথা নষ্ট। এই ছবি দেখবো আমরা! পোস্টার থেকে চোখ ফেরানো কঠিন।
টিকিট কাইটা ঢুকলাম, আমাদের সিট সামনে থেকে তিন নাম্বারে। আমরা সবাই খুশি সামনে বসতে পেরে। মাহাবুব ছাড়া আমাদের দুইজনের উত্তেজনা অনেক বেশি। আমরা এর আগে কখনো এই ধরনের ছবি দেখি নাই। অপেক্ষার পর এক সময় পর্দায় আলো পরলো। প্রথমে জাতীয় সঙ্গীত, সবাই দাঁড়াইয়া হাত নাড়ে, হাত নাড়ে কেন কিছুই বুঝলাম। মনে হলো এটাই নিয়ম। আমরাও দাঁড়াইয়া হাত নাড়লাম। প্রথমে একটা চাইনিজ ছবি, কথা ইংরেজিতে সাবটাইটেলো ছিলো। বেশ ভালো মারামারির ছবি, একেকটা মানুষ বিশাল বিশাল। ভিলেনরে নায়ক মারলে সবাই জোরে জোরে হাতে তালি দেয়। কেউ কেউ বলে উঠে, ‘আরো জোরে মার, আরো জোরে।’ মারামারি দেখতে দেখতে কখন যে সময় চলে গেলো বুঝতেও পারলাম না। মানে প্রথম ছবি শেষ হয়ে গেলো। মাহাবুব আগে থেকেই বলে রাখছিলো, ‘প্রথমে তেমন কিছু দেখতে পারবি না। দ্বিতীয়টায় দেখাইবো।’
শুরু হলো দ্বিতীয় ছবি। দ্বিতীয় ছবিটা কিছুটা রোমান্টিক। পুরা ছবিতে আমাদের প্রত্যাশা মতো মাত্র দুইটা দৃশ্য। একটা গোসলের দৃশ্য, আরেকটা ধর্ষনের চেষ্টা। তারপরেও আমরা খুশি একে তো প্রথম হলে ছবি দেখা তার উপর ইংলিশ ছবি। বাইরে বের হয়ে আইসা মাহাবুব বললো, ‘দোস্ত তোদের ভাগ্য খারাপ আজকে তেমন কিছুই দেখায় নাই। এইটা টু এক্সের মতো। মাঝে মাঝে থ্রি এক্সও দেখায়।’ আমরা মাহাবুবের কথায় কিছুটা হতাশ হলাম। দোষ দিলাম ভাগ্যকে।
এখন আর মাহাবুব নাই। কই আছে জানিও না। এখন গুলিস্তান হলও নাই। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল এক মার্কেট। এখন সবই স্মৃতি।
মাহাবুব যে থ্রি এক্সের কথা বলেছিলো, সেই থ্রি এক্স দেখার জন্য আমাকে আরো তিন বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিলো। সেই ছবিটা দেখছিলাম গাবতলীর পর্বত হলে। সেই গল্প আরেকদিন হবে। 🙂
