স্কুল আমাকে কোনদিন টানে নাই। শুধু প্রথম শ্রেণিতে থাকার সময় স্কুলে যেতে ইচ্ছা করতো। তাও ৭/৮ মাস হবে, শেষের ৩/৪ মাস স্কুলে যাই নাই। প্রথম শ্রেণিতে তিনজন স্যার ছিল, তিনজনের মধ্যে জসীম উদ্দীন পালোয়ান স্যারকে ভাল লাগতো। আমার পুরা স্কুল জীবনে কোন শিক্ষক পড়ালেখার বিষয়ে আকৃষ্ট করতে পারে নাই। পড়ালেখার বাইরে তিনজন শিক্ষক আমাকে আকৃষ্ট করতে পেরেছিলেন। একজন মাওলানা মোহাম্মদ আলী স্যার (স্যারের গল্প আরেকদিন বলব)। একজন স্যারের নাম মনে নাই, আমাদের বিজ্ঞান পড়াতেন। আরেকজনের পুরা নাম বলছি না। কিছুটা রহস্য করে নাম বলছি হেলেন আপা। ট্রয়ের হেলেন থেকেই নামটা দিলাম। কিন্তু পুরাপুরি ট্রয় থেকে নেয়া না, এই নামের অনেক মিল আছে। ম্যাডামের পুরা নাম না বলার কারণ লেখার কোথাও বের হয়ে আসবে।
আমার স্কুল জীবনে সবচাইতে বেশি ক্লাশ করেছি সম্ভবত চতুর্থ শ্রেণিতে থাকার সময়। একটা ছোট্ট পরিসংখ্যান দিলেই পরিস্কার হয়ে যাবে। চতুর্থ শ্রেণিতে সারা বছরে স্কুলে অনুপস্থিত ছিলাম ১২ দিন। আর নবম শ্রেণিতে সারা বছরে স্কুলে উপস্থিত ছিলাম ১২ দিন। সেই ১২ দিনও সম্ভবত গিয়েছিলাম প্রবেশ পত্র আনতে আর রেজিস্ট্রেশন করতে। চতুর্থ শ্রেণিতে সারা বছর স্কুলে যাওয়ার কারণ ছিল সম্ভবত ম্যাডাম। কোন অজানা কারণে ম্যাডামকে ভালো লাগত। ঐ সময়ে সম্ভবত ম্যাডাম স্কুলের সবচাইতে কম বয়সী শিক্ষিকা ছিলেন।
চতুর্থ শ্রেণির প্রথম দিনের বাংলা ক্লাশে পুরাই টাস্কি খাইয়া গেলাম। একজন ম্যাডাম ক্লাশ নিতে আসলেন। টাস্কি খেলাম ম্যাডাম বলে না, টাস্কি খাইলাম অন্য কারণে। উনাকে কেন জানি একদম অন্যরকম লাগলো। ঐ অল্প বয়সে ম্যাডামকে কেন অন্য রকম লেগেছিল সেটা আজও রহস্য।
ম্যাডাম ক্লাশ নিতেন টিফিনের পরে। টিফিন প্রথম চার ক্লাশ পরে। সব মিলিয়ে ক্লাশ হতো ছয়টি। ম্যাডাম যদি টিফিনের আগে ক্লাশ নিতেন তা হলে হয়তো আমার টিফিনের পরের ক্লাশগুলিও করা হতো না। তিনি আমাদের বাংলা পড়াতেন। প্রতিদিন পড়া দিতেন পরের দিন এসে পড়া নিতেন। প্রথমে এসেই বলতেন যারা পড়া শিখে আসো নাই তারা কান ধরে দাঁড়িয়ে থাক। যারা পড়া পড়ে এসেছে তাদের পড়া নেয়া শেষ হলে যারা পড়ে আসে নাই তাদের দুই হাতে দুইটি বেতের বাড়ি দিয়ে বসিয়ে দিতেন। আমিও প্রতিদিন কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতাম দুইটা বেতের বাড়ি খেতাম।
একদিন গরুর রচনা পড়া দিয়েছেন। আমি অনেক কষ্ট করে মুখস্থ করে ক্লাশে এসেছি। এর আগেও অনেকবার ম্যাডামের পড়া শিখে এসেছি কিন্তু কোনদিন পড়া দিতে পারি নাই। ভিতর থেকে পড়া আসতো না। সব ভুলে যেতাম। অনেক সাহস সঞ্চয় করে ম্যাডামের সামনে পড়া দিতে দাঁড়িয়েছি কিন্তু যে লাউ সেই কদু। গরুর দুইটা মাথা, একটা শিং এইসব হাবিজাবি বলে তালগোল পাকিয়ে দিলাম। শাস্তিস্বরূপ আমাকে দুইয়ের জায়গায় চারটা বেতের বাড়ি খেতে হইল। আমি আর ম্যাডামের সামনে পড়া দেয়ার চেষ্টা করি নাই। মুগ্ধ হয়ে ম্যাডামকে দেখতাম আর প্রতিদিন দুইটা করে বেতের বাড়ি খেতাম।
চতুর্থ শ্রেণির পরে আর ম্যাডামের ক্লাশ করা হয় নাই। কারণ ম্যাডাম সাধারণত পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্তই ক্লাশ নিতেন। ক্লাশ ছাড়ার পরেও ম্যাডামকে প্রায়ই মনে পড়তো। অনেকের সঙ্গেই ম্যাডামের গল্প করতাম। মাঝে মাঝে স্কুলের ধারেকাছে গেলে মনে মনে ম্যাডামকে খুঁজতাম। এক সময় ম্যাডামকে হারিয়ে ফেললাম। হারিয়ে ফেললাম বলতে নাখালপাড়া ছেড়ে দেয়ার পর আর দেখা হতো না।
বহু বছর পর প্রায় ১০/১২ বছর পর সেই রকম ঘটনা আবার ফিরে আসল। এবারের বিষয়টা একদম অন্য রকম। এক সাইকেল ভ্রমণে এক স্কুলে ঢুকলাম। স্কুলে ঢুকে টিচার্স রুমে ঢুকেই পুরাপুরি অবাক। মনে হলো আমি আবার সেই ১০/১২ বছর আগে ফিরে গেলাম। হেলেন ম্যাডামের সঙ্গে এই ম্যাডামের চেহারার মিল সামান্য কিন্তু কোথায় যেন অনেক মিল। আমি সেই মিলটা এখনও খুঁজি। এখানেও ম্যাডামের নাম উল্লেখ করলাম না। এখানে শুধু স্কুলের নামটা উল্লেখ করি, জনসম্মেলনী প্রবেশিকা বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়।
বছর খানেক আগে আচমকাই হেলেন ম্যাডামকে খুঁজে পেলাম ফেসবুকের কল্যাণে। ম্যাডামের প্রফাইল ঘাটাঘাটি করে দেখলাম ম্যাডাম নিয়মিত লেখালিখিও করেন। বাজারে কিছু বইও বের হয়েছে। আমি সাধারণত নিজে থেকে কাউকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাইনা। কিন্তু ম্যাডামকে পাঠালাম, সঙ্গে একটা ম্যাসেজ: ম্যাডাম কেমন আছেন? আমি একসময় আপনার ছাত্র ছিলাম’। ম্যাডামের উত্তর, ‘ছাত্রদের অ্যাড করি না, তবে এক্স স্টুডেন্ট বলে কিছু নাই।’ তবে তিনি আমাকে ঠিকই অ্যাড করলেন। এই কথার পর মনের গভীরে জেগে উঠেছে সেই স্কুলজীবনের কথা… কিন্তু একই মানুষ, একই জগত, অন্যরূপ…
১৪ আষাঢ় ১৪২২
জীবনের আয়নায় একটু আঁচড় কেটে যাওয়া কতোশত ঘটনা এভাবে মাঝে মাঝেই আমাদের মনে পড়ে..। আমরা কি আসলে সামনে যাচ্ছি..? নাকি থেমে আছি..? এই যে অনেকদিন পর ফেসবুকে মেডামের দেখা পাওয়া..। এটা কি অতীতকে বর্তমানে ফিরিয়ে আনা নয়..?
ভাই আপনার উত্তরটা সরাসরি আমি দিতে পারলাম না। আমার এক কবি বড় ভাইয়ের উদ্বৃতি দিলাম, এইটা আমি অনেকেরেই দেই। আবার নতুন করে দিলাম,
“ইতিহাস অতীত নয়। ইতিহাস বর্তমান। মানুষ যেহেতু সংকটের ভিতর দিয়ে যায় সেহেতু বর্তমানের সংকট অতীতেই গাঁথা আছে। অপরভাবে বলা যায়, ভবিষ্যতের সংকট বর্তমানেই। শুধু দিনক্ষণ আলাদা।”–কবি সাখাওয়াত টিপু