ফিমেল টিউটোর ওয়ান্টেড

ছোট বেলায় অ আ এ ঈ শিখছি বড় ভাই আর বোনের কাছে। আমি সব সময় ঘুমাতাম বড় বোনের সঙ্গে। মার সঙ্গে কবে ঘুমাইছি মনে পড়ে না। ঘুমানোর সময়ই স্কুলে ভর্তি হওয়া আগেই অনেক কিছু শিখে ফেলেছিলাম বোনের কাছে। ঘুম পারানোর নাম করে আপা অনেক কবিতা মুখস্থ করাইয়া ফেলাইছিল। আম পাতা জোড়া জোড়া/ মারব চাবুক…, আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা, খোকন খোকন ডাক পাড়ি। এইসব কবিতা অ আ লিখতে শেখার আগেই মুখস্থ করে ফেলেছিলাম। শুধু বাংলা না। ইংরেজি টুয়েঙ্কেল টুয়েঙ্কেলও মুখস্থ করে ফেলেছিলাম। যা বর্তমানেও মুখস্থ।

আমার পড়ালেখা বিষয় কোন কিছুই আমি আমার বাবা-মার কাছ থেকে শিখতে পারি নাই। এর দুইটা কারণও ছিল। বাবা খুব ভোরে বালিশের নিচে দুই টাকা রেখে চলে যেতেন ফিরতেন রাত ৯/১০ টার দিকে। আর মা সারাদিন সংসারের কাজে ব্যস্ত থাকতো। আর একটা কারণ, মা পড়ালেখা জানতো না সব সময় টিপসই দিয়েই কাজ চালাতো। যদিও আমি বড় হওয়ার পর মাকে স্বাক্ষর দেয়া শিখিয়েছিলাম। আর বাবাও পড়ালেখা করেছেন তৃতীয়/চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত। তারপরেও আমাদের প্রাথমিক শিক্ষার জন্য কোন সমস্যা হয় নাই। আমার অনেক বন্ধুদের দেখেছি তাঁরাও প্রাথমিক শিক্ষাটা বাবা-মা, ভাইবোন অথবা পরিবারের কারো কাছ থেকে শিখেছে। মাধ্যমিকের আগে আরই টিউটোরের কাছে যেতে হতো না।

আমি যখন তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হলাম তখন বাবার এক বন্ধুর মেয়ে সময় কাটানোর জন্য আমাকে ২/৩ মাস পড়িয়েছিলেন। তাঁর নাম ছিল হীরা। হীরা আপার কাছে প্রতিদিন সন্ধ্যায় পড়তে যেতাম। এরপরে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় ফুপাতো বোন আর্জিনা আপার কাছেও ১/২ মাস পড়েছিলাম। আর্জিনা আপার কাছে একটা বিষয় শিখেছিলাম যা এখনো ভুলি নাই। সেটা হইল বড়রা ডাকলে ‘জ্বি’ বলে সারা দিতে হয়। আর ছোটদের ‘কি’ বললে সমস্যা নাই। এঁদের কাউকেই পয়সা দিতে হইত না। নবম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার সময় এনামুল হক (লুলু স্যার) স্যারের কাছে পড়তে যাওয়া শুরু। এই স্যারকেই বলা যায় আমার একমাত্র শিক্ষক। অন্য কোন স্যারের কাছে আমি পড়ি নাই। পড়তে হয়ও নাই। কোন সমস্যা হলে বন্ধুদের কাছ থেকে একটু দেখে নিতাম।

মাঝে মাঝে পরিচিত অথবা অপরিচিত কিছু একটা বিষয় দেখলে পুরনো অনেক স্মৃতি সামনে চলে আসে। আজ অফিসের কাজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্যারের অফিসে গিয়েছিলাম। কিভাবে যেতে হয় কোন ভবনে বসেন তা আগেই সলিমুল্লাহ স্যার বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। স্যার এমনভাবে বুঝিয়ে দেন সবসময় যে কাউকে জিজ্ঞেস না করেই জায়গামত চলে যাওয়া যায়। কলা ভবনে দ্বিতীয় তলায় গিয়ে স্যারের সহকারীর কাছ থেকে একটা পেপার নিয়ে বের হওয়ার পর। নোটিশ বোর্ডের পাশে একটা কাগজে চোখ আটকে গেল।

কাগজে প্রথমেই বড় করে ইংরেজিতে লেখা, ‘ফিমেল টিউটোর ওয়ান্টেড’। দ্বিতীয় লাইনে লেখা ঠিকানা দেয়া আছে, ‘ধানমন্ডি (সঙ্গে রোড নাম্বার)’। তৃতীয় লাইনে সংক্ষেপে, ‘স্টু. ওয়ান’। চতুর্থ লাইনে, বেতন ৫০০০/-। পঞ্চম লাইনে একটা মোবাইল নাম্বার ব্র্যাকেটে ‘ফাদার’। এই সবগুলা লাইনই ইংরেজিতে লেখা ছিল।

আমি কিছুক্ষণ কাগজটার দিকে তাকিয়ে থেকে আমার গন্তব্যে রওনা দিলাম।

একজন প্রথম শ্রেণির ছাত্র/ছাত্রীর জন্য ৫০০০ টাকা দিয়া শিক্ষিকা রাখতে হয়। আশ্চর্য! আসলে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নাই। সামনে নিশ্চয়ই আমাদের জন্য আরো অনেক কিছু অপেক্ষা করতেছে।

.

৪ কার্তিক ১৪২২

Comments

comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.