বাংলায় লিখি

“সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে
বিশ্বরূপে বিশালাক্ষী বিদ্যংদেহী নমোহস্ততে”

“হে মহাভাগ সরস্বতী, বিদ্যাদেবী, কমলনয়না,
বিশ্বরূপা, বিশালাক্ষী, আমাকে বিদ্যা দাও। তোমাকে নমস্কার।”

সকাল সকাল অফিসে এসেই আবার বাইরে দৌঁড়। এক ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে হবে। সেইটা আরেক ব্যাংকে জমা দিতে হবে। হরতালের কারণে রাস্তা ফাঁকা। ব্যাংকও ফাঁকা। প্রথম ব্যাংক থেকে টাকা তুলে দ্বিতীয় ব্যাংকে গেলাম। সেই ব্যাংকও ফাঁকা।

টাকা জমা দেয়ার রশিদ নিয়ে লিখে লাইনে দাঁড়ালাম। আমি তৃতীয় সামনে দুইজন। একজন টাকা তুললেন, কাউন্টারে বসে থাকা রূপবতী অফিসার কাজ শেষে বিদায় দেয়ার সময় মিষ্টি করে বলেন “থ্যান্ক ইউ” (এইটা মনে হয় ট্রেনিংয়ের সময় শিখিয়ে দেয়া হয়, কিভাবে কাস্টমারদের সঙ্গে ব্যবহার করতে হয়)। আমার সামনের জন টাকা জমা দিলেন তিনিও মিষ্টি গলার “থ্যান্ক ইউ” পেলেন।

আমি মোটামুটি নিশ্চিত টাকা জমা দেয়ার পর “থ্যান্ক ইউ” পাব। যদিও আমার জমা দেয়া টাকার পরিমাণ খুবই অল্প। “থ্যান্ক ইউ” দেয়ার সময় নিশ্চয়ই টাকার কথা হিশাব করে না। আমি গেলাম কাউন্টারে, প্রথমে টাকা দিলাম তারপর রশিদ। তিনি আমার দিকে একবার তাকালেন। তাঁর ব্যাচ দেখে বুঝতে পারলাম উনার নাম সায়মা অথবা সায়েমা। তিনি টাকা গুনার পর রশিদ নিয়ে আমার দিকে তাকালেন। কম্পিউটারে লিখতে আমার দিকে কয়েকবার তাকালেন।

আমার বড় চুল-দাড়ি দেখে মোটামুটি একবার দুইবার তাকায় তাও খুবই কম। ঢাকার বাইরে গেলে একটু বেশি তাকায় এটা ঠিক। কিন্তু ঢাকায় এমন সাধারণত হয় না। যদি কেউ ঢাকায় নতুন আসে অথবা এই ধরনের মানুষ এর আগে না দেখে তাহলে ভিন্ন কথা। কিন্তু সায়মা আপু কেন বার বার তাকাচ্ছিলেন সেটা একটু খটকা লাগার মতই বিষয়। কারণ উনি এই দৃশ্য অবশ্যই পার করে এসেছেন। কিছুক্ষণ পর পরিষ্কার হলাম কেন তিনি এতবার তাকিয়েছেন।

তাঁর কাজের শেষ পর্যায়ে তিনি বললেন, “ভাইয়া আমি ব্যাংকে কাজ করছি বেশিদিন হয় নাই, বছর খানেকের মত হবে। এই এক বছরে কাউকে দেখি নাই এভাবে জমা দেয়ার রশিদে বাংলায় লিখতে। আপনি কি নিয়মিত এভাবে টাকা জমা দেয়ার সময় বাংলায় লিখেন?” আমি বললাম “চেষ্টা করি”।

তিনি রশিদে সিল দিয়ে, রশিদের আমার অংশটি আমাকে ফেরত দিয়ে বললেন, “ধন্যবাদ”।

DSC03005

সলিমুল্লাহ খানের ভাষায় বলতে হয়, “কিন্ডার গার্টেন বা শিশুর বাগান পর্যন্ত এখন প্রায় সম্পূর্ণ বাংলামুক্ত হইয়াছে। এই পরিস্থিতিতে বাঙ্গালি সংস্কৃতি আবার নিম্নবর্ণের হইয়া উঠিতেছে। হয়ত সেখানেই তাহার শেষ আশ্রয় হইবে।” বাংলা ভাষা হয়ত শেষ পর্যন্ত গরীব মানুষের ভাষা হয়েই থাকবে।

আমার মত নিম্নবর্ণ আর মূর্খ মানুষ এই দেশে কি বা করতে পারি বাংলায় লেখা ছাড়া, বাংলায় পড়া ছাড়া, বাংলা স্বপ্ন দেখা ছাড়া? আর পারি আমার ছোট্ট চিলেকোঠায় দরজা-জানালা বন্ধ করে, বদ্ধ ঘরে চিৎকার করে বলতে “রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই” (যাতে কেউ না শুনে)…

১২ মাঘ ১৪২১

Comments

comments

Comments

  1. কোরেশী

    মাঝে মাঝেই চুপিসারে এসে পড়ে যাই তোমার লেখা। লেখা পড়ার পর কোন মন্তব্য করি না; তাই চুপিসারে শব্দটা ব্যবহার করা যেতেই পারে। একটা ভাষা ভালো ভাবে বলতে, পড়তে আর লিখতে পারাটাই অনেক বড় ব্যাপার। একাধিক হলে তো আরো ভালো। অন্য অনেক কাজের মতো আমরা বেশির ভাগ বাঙালী ভাষার ব্যাপারেও চরম অরাজক অবস্থা সৃষ্টি করেছি। এর দায় আমার, আমাদের।

    1. ভাই আপনে যে আমার লেখা নিয়মিত পড়েন এটা জেনে খুবই ভাল লাগতেছে। অনেক ধন্যবাদ।

      একদিন হুট করে চলে আসব জ্বালাতন করার জন্য।

      1. কোরেশী

        তুমি তো আর পেট্রল দিয়ে জ্বালাবা না 🙂 । তাই চলে আসো, যতো পারো জ্বালাও, আমি আছি 😀

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.