বাংলা হৌক প্রাণের ভাষা

DSC03005

এক

কয়েক বছর আগের ঘটনা, কাজ করি এলিফেন্ট রোডে একটি প্রতিষ্ঠানে, নাম এশীয় শিল্প ও সংস্কৃতি সভা। একদিন এলিফেন্ট রোড থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যাব। এক রিক্সা ওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মামা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যাবেন?’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘মামা আমি তো চিনি না, আপনি বইলা দিয়েন কিভাবে যাব।’ আমি রাজি হয়ে গেলাম। রিক্সা ওয়ালাকে চিনিয়ে নিয়ে গেলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। রিক্সাওয়ালা আমাকে বললেন, মামা আমি এই জায়গা চিনি, আপনি ইউনিভার্সিটি বললেই হতো। আমি হতবাক হয়ে গেলাম। একজন রিক্সাওয়ালা ইউনিভার্সিটি বললে চেনে আর বিশ্ববিদ্যালয় বললে চেনে না। তাকে বুঝিয়ে বললাম ইউনিভার্সিটি আসলে ইংরেজি শব্দ, ইউনিভার্সিটি অর্থ হলো বিশ্ববিদ্যালয়। তিনি খুশি মনে ভাড়া নিয়ে বিদায় হলেন। এই হলো আমাদের বাংলা ভাষার অবস্থা!

দুই
হঠাৎ এক রাতে একটি ফোন পেলাম, মোবাইলের স্কিনে অনেকগুলো ডিজিট, দেখেই পরিষ্কার হলাম এটা আমাদের দেশের নাম্বার না দেশের বাইরে থেকে কেউ ফোন করেছে। তখন রাত প্রায় ১ টার মতো বাজে। ভদ্রলোক একজনের নাম বললেন, আমি শুনেই বুঝতে পারলাম এটা রং নাম্বার। আমি তাকে বললাম ভাই, আপনি রং নাম্বারে ফোন করেছেন, আপনি সঠিক নাম্বারটি দেখে আবার ফোন করেন আমি রাখি। তিনি তড়িঘড়ি করে বললেন, ‘ভাই রাইখেন না, আপনার সঙ্গে একটু কথা বলি।’ আমি তো অবাক! আমার সঙ্গে কি কথা? তিনি তার পরিচয় দিলেন। তার বাড়ি কুমিল্লার কোন এক জায়গায়, এখন ফোন করেছেন সৌদি-আরব থেকে। তিনি অনেক কষ্ট নিয়ে বললেন, ভাই থাকি মরুভূমিতে। আশে পাশে কেউ নেই, ১৫ দিন পর পর মালিক এসে খাবার-দাবার দিয়ে যায়। অনেকদিন পর পর বাড়িতে ফোনে কথা বলি বাইরের কারও সঙ্গেই কথা হয় না। এখানে কয়েকদিন পর পর যে কয়েকজনের সাথেই কথা বলি না কেন, কথা বলতে হয় আরবিতে। কতদিন পর যে একজন বাইরের মানুষের সঙ্গে বাংলায় কথা বলতেছি তা আমার মনে নাই। আর আপনার সাথে কথা বলে যে কি শান্তি লাগতেছে আপনাকে বলে বোঝাতে পারবো না। তিনি আমার সঙ্গে প্রায় ৩০ মিনিটের মতো কথা বললেন, তাঁর কথায় বুঝতে পারলাম বাংলা ভাষাভাষি মানুষের অভাবে বাংলায় কথা বলতে না পারাও অনেক যন্ত্রণাদায়ক।

তিন
২০১০ সালের অক্টোবর-নভেম্বরে একটি সাইকেল ভ্রমণের আয়োজন করা হলো নাম ক্লেমন রাইড ফর গ্রিন। ১০ জন বাংলাদেশী সাইক্লিস্ট আর ১০ জন ব্রিটিশ সাইক্লিস্ট অংশগ্রহণ করবেন। সিলেট থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত। এছাড়াও বিভিন্ন জেলা থেকে আরো কিছু সাইক্লিস্ট অংশগ্রহণ করবেন। বাংলাদেশের ‘কেউক্রাডং বাংলাদেশ’ থেকে আমরা দশজন গেলাম মূলত ইমরান ভাই আমাদের ১০ জনকে ঠিক করলেন। ব্রিটিশ ১০ জনের মধ্যে ৩/৪ জন ছাড়া সবাই আসলে সিলেটের তবে সবাই লন্ডনেই থাকেন। আমরা সবাই মিলে বেশ কয়েকদিন এক সঙ্গে সাইকেল চালিয়েছি। ব্রিটিশদের মধ্যে অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে এবং বেশ ভালো বন্ধুত্বও হয়ে গিয়েছিল। যে ৬/৭ জন সিলেটী ছিল তারা কেউই ঠিক মতো বাংলা বলতে পারতেন না। কথা বলতেন সিলেটী টানে এবং বাংলার মাঝখানে ইংরেজি শব্দ ঢুকিয়ে দিতেন। একদিন তাঁদের মধ্যেই একজন আমিনুর ভাই আমাকে খুব দুঃখ করে বললেন, ‘শরীফ ভাই, আমরা বাঙ্গালী ঠিকই কিন্তু বাংলা জানি না, এটা আমাকে প্রায়ই খুব দুঃখ দেয়। এর জন্য আমি নিজেই নিজের কাছে অপরাধী।’ কিন্তু আমরা বাংলাদেশীরা মনে করি বাংলার মাঝখানে ইংরেজি ঢুকালে আমি অন্য সবার চেয়ে ‘স্মার্ট’ বা ‘পটু’।

চার
গতবছরে একটি অনুষ্ঠানে কাজ করতে গেলাম গুলশানে। বিশাল এক ইভেন্ট নাম হে ফ্যাস্টিভাল ঢাকা। বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশের বেশ কয়েকটি শহরে এই ফ্যাস্টিভাল হয়ে থাকে। মুলত লেখক আর পাঠকদের নিয়েই এই ফ্যাস্টিভাল। ইভেন্টটির মিডিয়ার কাজকর্ম করার জন্য দায়িত্ব দেয়া হলো নাহিদ কামাল নামের একজনকে। তিনি কাজ করেন একটি ইংরেজি দৈনিক পত্রিকায়। তিনি এই অনুষ্ঠানের জন্য একটি প্রেস রিলিজ লিখবেন, কিন্তু বাংলায় লিখতে পারেন না। কোন এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একজনকে ডেকে এনে ইংরেজিতে প্রেস রিলিজ লিখে অনুবাদ করতে দিলেন। অনুবাদ করার পর যা হওয়ার তাই হলো, পুরোপুরি আক্ষরিক অনুবাদ। যা পত্রিকায় দেয়ার এতটুকু যোগ্যতা নেই। পরবর্তীতে আমি আর মশিউর ভাই দুইজনের মিলে প্রেস রিলিজটি লিখে দেই। এই বাঙ্গালী ভদ্র মহিলা কথা বলেন বাংলায় ঠিকই, কথার টান ঠিক বাংলার মতো না পুরোপুরি ইংরেজি টান, শুনতে হাস্যকর লাগে। তার কথা শুনলে মনে হয় অনেক কষ্ট করে বাংলা বলছেন। অথচ আমাদের কিনা বায়ান্নতে প্রাণ দিয়ে এই ভাষা আদায় করতে হয়েছে।

পাঁচ
একদিন ফেসবুকে রাহাত ভাইয়ের স্ট্যাটাস দেখলাম। তারিখটা ছিল সম্ভবত ৯ জানুয়ারি ২০১৩। তাঁর লেখাটা ছিল এমন, ‘ইংলিশ এর এই যুগে ঠিক করলাম মেয়েকে বাংলাতেই পড়াবো।’ সেই স্ট্যাটাস এর নিচে অনেক রকম কমেন্ট পড়েছিল, কোন একজনের কমেন্টের উত্তরে রাহাত ভাই আরো বললেন, ‘সিদ্ধান্তটা আজ সকালের, ভেবে দেখলাম মেধা আসলে ভাষা দিয়ে নয়Ñ চিন্তা, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ও জানার ইচ্ছা থেকে আসে।’ সিদ্ধান্তটা হয়তো সাধারণ মনে হতে পারে, কিন্তু আমার কাছে এর গুরুত্ব অনেক বড় হয়ে দেখা দিল। আমিও সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম, আমার পরবর্তী সাইকেল ভ্রমণ হবে ভাষা বিষয়ক। অর্থাৎ ঢাকার বাইরের সাধারণ মানুষ বাংলা ভাষাকে কিভাবে দেখে, কিভাবে চর্চা করে তা জানার চেষ্টা করবো।

এই লেখাটি রাহাত ভাইকে উৎসর্গ করলাম। তার অসাধারণ একটি সিদ্ধান্তের জন্য এবং তাঁর মেয়ের জন্য দোয়া রইল, সে যেন অনেক বড় হয় এবং বাবার মতো সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

 

Comments

comments

Comments

  1. ভালো লাগলো। আজকের দিনের জন্য চমৎকার একটা লেখা। রাহাত কে অভিনন্দন। দোয়া রইল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.