বাল্য শিক্ষা

ছোটবেলার কিছু একটা বিষয় মাথায় ঢুকলে খুব একটা সহজে বের হয় না। শেখার জন্য অল্প বয়সটা মনে হয় খুবই ভাল।

বাসা থেকে ব্যবসার কাজের জন্য আব্বার পুরান ঢাকার কয়েকটা জায়গায় যেতে হইত। বাজারে যাওয়ার মতো সেইসব জায়গায় যাওয়ার জন্য আমরা দুই ভাই সব সময় বায়না ধরতাম। আব্বা প্রতি বৃহস্পতিবার বিকালে মালামাল আনার জন্য যেতেন। এক সপ্তাহ আমাকে নিয়ে যেতেন আরেক সপ্তাহ ছোট ভাইকে নিয়ে যেতেন। বৃহস্পতিবারে স্কুল হাফ ছিল তাই বিকালে আমাদের যেতে সমস্যা হতো না।

আমাদের যেতে চাওয়ার মূল আগ্রহের জায়গা ছিল খাওয়াদাওয়া করা আর একটু ঘুরাঘুরি। প্রথমে নাখালপাড়া রেইলগেট থেকে টেম্পুতে করে ২ টাকা ভাড়া দিয়ে ফার্মগেট যেতাম। তখন আব্বার কোলে বসে যেতাম। বাসে উঠে দেড় টাকা দিয়ে বঙ্গবাজার। ৫০ পয়সা বেশি দিলে গুলিস্তান যাওয়া যেত অর্থাৎ ফার্মগেট থেকে গুলিস্তানের ভাড়া ছিল দুই টাকা। বাসে কোলে বসতাম না, আব্বার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতাম। জানালা দিয়ে অবাক হয়ে গাড়ি দেখতাম। বঙ্গবাজার নেমে রিক্সায় মিটফোর্ড, রিক্সা ভাড়া ছিল সম্ভবত ৮ থেকে ১০ টাকা। মিটফোর্ড থেকে ক্যামিকেল নিয়ে আমরা হেঁটে হেঁটে বেগম বাজার যেতাম। বেগম বাজারে কিছু জিনিশপত্র কেনা হতো মাঝে মাঝে চকবাজারেও যেতে হত। সব কিছু শেষ করে বেগমবাজার মোড়ের একটা হোটেলে বসে কিছু নাস্তা খাওয়া হতো। তারপর রিক্সায় করে সরাসরি নাখালপাড়া। ভাড়া লাগতো ২৫ থেকে ৩০ টাকা। এই রিক্সার ভ্রমণটাও খুব মজার ছিল।

রিক্সাটা জেলখানার সামনে দিয়ে চাংখারপুল, দোয়েল চত্ত্বর, হাইকোর্ট, মগবাজার, সাতরাস্তা নাবিস্কো দিয়ে নাখালপাড়ায় আসতো। পথে আসতে আসতে আব্বা আশেপাশের বিল্ডিং আর জায়গার নাম বলতেন। এইটা দোয়েল চত্ত্বর, এইটা হাইকোর্ট এভাবে এটা সেটা দেখাতে দেখাতে বাসায় নিয়ে আসতেন। ১৫ দিন পরে আবার আমাকে নিয়ে গেলে জিজ্ঞাসা করতেন বলো তো এইটা কি? ওইটা কি? এভাবেই প্রাথমিক স্কুল পার হওয়ার আগেই অনেক কিছু শিখে ফেলেছিলাম।

নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের বাচ্চারা মনে হয় কাজের মাধ্যমে বাস্তবতা থেকে অনেক কিছু শিখে ফেলে। আমিও এভাবেই অনেক কিছু শিখে ফেলেছিলাম। এই বিষয়গুলা যে কি পরিমাণ কাজে লাগতেছে এখন তা বলে বুঝানো যাবে না।

কিছুদিন পরে আব্বার ব্যবসার কাজে আম্মাও সহযোগিতা করা শুরু করলেন। একবার ঠিক হইল এখন থেকে আর আব্বা মালামাল আনতে যাবেন না। এখন থেকে আম্মা যাবেন। আম্মা তেমন কিছু চেনেন না কিন্তু আমরা দুই ভাই তো চিনি। সেভাবেই শুরু হইল জিনিশপত্র আনা। আম্মাকে নিয়া আমরা যেতাম। কিন্তু আম্মাকে নিয়ে যেতে একদমই ভাল লাগতো না। কারণ হোটেলে বসে খাওয়া যেত না। আর জার্নিটা একদমই বোরিং টাইপের।

আবার আরেক দিক দিয়া ভালও লাগে আম্মাকে তো নিয়ে যাচ্ছি। আম্মা বড় হইলেও এখানে আম্মা আমার চাইতে অভিজ্ঞ না। সব জায়গায় তাঁকে দেখিয়ে দেখিয়ে নিতে হয়। টাকা পয়সাটা শুধু আম্মার হাতে থাকে বাকী সব আমার নিয়ন্ত্রণে। একদিক দিয়া আম্মা অভিভাবক হইলেও রাস্তায় নামার পর থেকে দেখা যাচ্ছে আমিই অভিভাবক। বাসের ভাড়া আমি দিচ্ছি, রিক্সা ভাড়া আমি দিচ্ছি, রিক্সা আমি ঠিক করছি। মনে হয় যেন আমি অনেক বড় হয়ে গেছি।

কিন্তু বিরক্ত লাগে যখন আম্মার কোলে বসতে হয়। টেম্পুতে তাও মানা যায় কিন্তু বাসে উঠে মহিলা সিটে আম্মার কোলে বসতে হয়। তখন খুব মনে হইত কবে যে বড় হবো। তবে ঐখানে বসেও একটা আনন্দের কাজ ছিল। যেহেতু ড্রাইভোরের পাশের সিট তাই আমি অবাক হয়ে ড্রাইভারকে দেখতাম। এত বড় একটা বাস ড্রাইভার চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কিভাবে চালাচ্ছে! কি অদ্ভুত ব্যাপার! পায়ের কাছে তিনটা জিনিশ সামনে গোল একটা জিনিশ আবার বাম হাত দিয়ে একটা ডাণ্ডা বিভিন্ন ভাবে ঘুরায়পেচায়।

আমার অপলক চোখে ড্রাইভারের ড্রাইবিং দেখা নিয়ে বাসায় এসে আম্মা সবাইকে বলে এইটা নিয়া খুব হাসাহাসি করেছিল। আমার তখন অনেক লজ্জা লেগেছিল। একটু একটু রাগও হয়েছিল।

বড় ভাই তখন ঢাকা পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে ডিপ্লোমা করতেছিল। বিষয় ছিল সম্ভবত অটোমোবাইল বা এইসব গাড়িটারি নিয়াই পড়াশুনা। একদিন সে ভাই ভালোমতো বুঝিয়ে দিয়েছিল। এইগুলা আসলে কি! গোলটার নাম স্টেয়ারিং। তারপর পায়ে যে তিনটা জিনিশ আছে সেই তিনটার নাম অনেক কঠিন মনে হইল। বড় ভাই খুব সহজ করে বুঝিয়ে দিলেন সংক্ষেপে ‘এ, বি, সি’। ‘এ’ তে ‘এক্সেলেটার’, ‘বি’ তে ‘ব্রেক’, ‘সি’ তে ‘ক্লাস’। আমি আর কখনো এইগুলা ভুলি নাই। মনের মধ্যে গেঁথে গেছে।

এই রকম আরো কিছু কিছু বিষয় ছোটবেলায় মাথায় ঢুকেছিল যা আজও বের হয় নাই।

হবেও না সম্ভবত…

 

২০ চৈত্র ১৪২৫

Comments

comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.