বিউটি থেকে শাবনুর, শাবনুর থেকে বিউটি

কোন এক রৌদ্রোজ্জল সকালে কোন কারণ ছাড়াই রেললাইন ধরে হাঁটছি। উদ্দেশ্য তেজগাঁও স্টেশন। উল্টা পাশ থেকে একটি মেয়ে আসছে। বয়স ষোল কি সতের। দূর থেকেই বোঝা যাচ্ছিল মেয়েটি চঞ্চল। আমার পাশ দিয়ে গান গাইতে গাইতে চলে গেল। এখন ঠিক মনে পড়ছে না কোন গানটি গাচ্ছিল। কিন্তু এটা যে কোন এক বাংলা ছবির গান তা এখনো পরিষ্কার মনে আছে। তথাকথিত আর্ট ফিল্ম না। পুরদস্তু ব্যবসায়িক ছবির গান। গতকাল গভীর রাতে আশেপাশের বাসা থেকে ভেসে আসছিল সে রকম গান। তাই নতুন করে সেই মেয়েটির কথা মনে পড়লো। পাশ দিয়ে যাওয়ার পর পরই তাঁকে আমি ভুলে গেলাম।

দুইচারদিন পরে একই পথে তাঁর সঙ্গে আবার দেখা। চুলে দুই পাশে বেনী করা। আমার উদ্দেশ্য তেজগাঁও স্টেশন কিন্তু তার উদ্দেশ্য কোথায় জানি না। এভাবে প্রায়ই দেখা হতে থাকলো। একদিন আবিস্কার করলাম রেললাইনের বস্তিতেই তার বসবাস। কেউ একজন ডাকছিল বিউটি বলে। বুঝতে পারলাম তাঁর নাম বিউটি। প্রতিদিন দেখা হতে হতে একদিন বড় মসজিদের সামনে আমাকে বলে ফেললেন কিরে কেমন আছিস? হঠাৎ করে তুই বলাতে আমি হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। আমার সঙ্গে তাঁর বয়সের পার্থক্য কম পক্ষে দশ হবে। তুই বলতেই পারে। কিন্তু আমাদের এলাকায় এইরকম বড় বড় আপুরা বা আন্টিরা কখনো তুই বলতো না। তাই অন্যরকম লাগছিল তাঁর তুই ডাকটা।

বাসায় আমার কাজ ছিল প্রতিদিন সন্ধ্যার পরে বাজার করা। একদিন সন্ধ্যার পরে বাজার করতে যাচ্ছি তখন বিউটি আপার সঙ্গে দেখা বেশ সাজুগুজু করে কোথায় যেন যাচ্ছে। এমন সাজুগুজু করে সন্ধ্যার পরে কোথায় যেন যায়, আমার সঙ্গে প্রায়ই দেখা হয়। কিন্তু কোনদিন কথা হয় না। একদিন আমাকে কেমন আছিস জিজ্ঞেস করেছিলেন সেটাও মনে হয় মনে নাই।

হঠাৎ করে আমার মাথায় ঢুকলো মার্শাল আর্ট শিখবো। মনা ভাই নামে এলাকার এক বড় ভাই ছিলেন। আমরা একই গলিতে থাকতাম । উনার একটা মার্শল আর্টের স্কুল ছিল, জিত কুণ্ডু মার্শাল আর্ট স্কুল। উনার সঙ্গে যাওয়া শুরু করলাম। বৃহস্পতিবার আর শুক্রবার বিকালে বারো নাম্বার গলিতে একটি পরিত্যাক্ত বাড়িতে শেখাতেন। আর শুক্রবার ভোরে জিয়া উদ্যান বা চন্দ্রিমা উদ্যানে ক্লাশ হতো। শুক্রবারে ভোরে উনি যাওয়ার সময় আমাকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে যেতেন। একদিন প্রেক্টিস করতে করতে দেখি, মাঠের পাশে বিউটি আপা ঘুমাচ্ছেন।

প্রতি শুক্রবারেই দেখা হতে লাগলো তাঁর সঙ্গে। মাথার মধ্যে চিন্তা খেলা করতে শুরু করল, প্রতিদিন এত ভোরে তিনি এখানে আসেন কেন? আর আসেনই যদি ঘুমান কেন? সবাই তো সকালে আসে হাঁটতে। এর মধ্যে একদিন দেখি তাঁর বান্ধবীরা তাঁকে শাবনুর বলে ডাকছে। একটা মানুষের দুই জায়গায় দুই রকম নাম হয় কিভাবে। নানারকম প্রশ্ন খেলা করতো।

এলাকার ছেলেপেলেদের সঙ্গে প্রায় শুক্রবার রাতেই সংসদ ভবনের দিকে ঘুরতে যেতাম। সেখানে গানবাজনা হত, আড্ডা হত, ছেলেমেয়েরা স্ক্যাটিং করতো। তখন সবাইকেই সংসদ ভবনের প্রাঙ্গনে ঢুকতে দিত আর ঢাকার অনেক লোকজন সেখানে ঘুরতে যেত। শুক্রবারে বেশি লোকজন হতো। আমরা দিনেও যেতাম সেটা ক্রিকেট খেলার জন্য। তো একদিন আমরা সন্ধ্যার আড্ডা দিয়ে একটু রাত করেই বাড়ি ফিরছিলাম। বিজয় সরণীর দিকে বিউটি আপার সঙ্গে দেখা সাজুগুজু করে দাঁড়িয়ে আছেন। সেই রাতে আমার সকল প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলাম বিউটি আপার সম্বন্ধে।

ছবি: পিনাক পাণি
ছবি: পিনাক পাণি

অনেকদিন পরে। নাখাল পাড়া ছেড়ে আমি তখন এলিফ্যান্ট রোডের বাসিন্দা। কিন্তু প্রতি রবিবারেই এলাকায় যাই। আবার বিউটি আপার সঙ্গে দেখা। ততদিনে আরো দশ বছর পার হয়ে গেছে। বিউটি আপার চেহারায় শরীরে বয়সের ছাপ পড়েছে, অনেক মোটা হয়ে গেছেন। ঐদিন আর তাঁকে শাবনুরের মতো মনে হইল না। আমার মাথায় আপনা থেকেই প্রশ্ন আসলো এখন তিনি কি করেন? আগের পেশায় নিশ্চয়ই তাঁর আকাল চলছে।

কিছুদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আরসি মজুমদার মিলনায়তনে গিয়েছি একটি সেমিনারে। সাদাত হোসেন মান্টোকে নিয়ে আলোচনা। সেখানে জাভেদ হুসেন নামে একজনের অসাধারণ বক্তৃতা শুনলাম। সেখানে মান্টোকে নিয়ে তিনি মান্টোর মাধ্যমে জানালেন, ‘আমার কাছে সেই নারী আবেদন রাখে, সেই আমার গল্পের নায়িকা হতে পারে যে সারারাত জাগে। যে সারাদিন ঘুমায়, ঘুমের মধ্যে হঠাৎ করে দুঃস্বপ্ন দেখে চমকে জেগে উঠে। কি দুঃস্বপ্ন? দুঃস্বপ্ন হলো সে নারী চিন্তা করে আমার বয়স হয়ে যাচ্ছে। দুদিন পরে আমি কি খাব? যখন আমার গায়ের চামড়া কুচকে যাবে। আমার চোখের উজ্জলতা থাকবে না। এই দুঃস্বপ্ন দেখে চমকে উঠে যে নারী একমাত্র সেই আমার নায়িকা হতে পারে।’

কিন্তু বাস্তবে তাঁরা হয়তো সবার লেখার নায়িকা হতে পারে না। তারা শুধু সারা জীবন নায়িকা হওয়ার অভিনয় করতে পারে। আমার কাছে বাস্তব জীবনের নায়িকা তারাই। আমি যখনই তাঁদের দেখি সব সময় হাসিমাখা মুখ দেখি। জীবনের এই সময়ে এসে আরও অনেক কিছু দেখেছি হয়ত আরও দেখব। সমাজ তাদেরকে গ্রহণ করেনা কিন্তু রাতের আবছা আলোতে সামাজিক কিছু মানুষ তাদেরই দারস্ত হয়। অদ্ভূত জীবন এই বিউটি অথবা শাবনুরদের…

Comments

comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.