১
সারাদিন কোন কাজকাম নাই। আড্ডা দেয়াই প্রধান কাজ। আড্ডার বেশ কয়েকটা জায়গা। এর মধ্যে প্রধান দুইটা। একটা আলীর বাড়ি আরেকটা হায়দার ভাইয়ের দোকানের সামনে। আড্ডায় হাতি-ঘোড়া-গরু-মহিষ সবই আমরা মারি। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই করি না।
আড্ডার মাঝে হঠাৎ করে ইব্রাহিম হাজির, সঙ্গে এক মধ্য বয়স্ক লোক। লোকটি বিপদে পড়েছে, বরিশাল যাবে হাতে টাকা নাই। সবাই মিলে ঠিক করলাম, লোকটিকে সহযোগিতা করবো। প্রথমেই হায়দার ভাইয়ের দোকান থেকে চাঁদা তোলা শুরু করলাম। পরিচিত অনেকগুলা দোকান থেকে টাকা তোলা শেষ করার পর একজন বুদ্ধি দিল যুবকল্যাণ সংঘে যাওয়ার। যুবকল্যাণ সংঘে অনেক বড় ভাইরা আছে ঐখানে গেলেই আর কোথাও দৌড়াতে হবে না। ঐ লোককে সঙ্গে নিয়ে যুবকল্যাণ সংঘে হাজির। সবাই মিলে ধরলাম মোস্তফা কাকাকে। কাকা সবার কাছ থেকে পাঁচশ টাকা তুলে দিলেন। আমরা বিভিন্ন দোকান থেকে কিছু টাকা তুলেছিলাম। সব মিলিয়ে ৭৩৫ টাকা।
আমরা মোটামুটি সবাই খুশি। অনেকদিন পর একটা ভাল কাজ করছি। লোকটাকে সব টাকা দিতে যাব এমন সময় কাইয়ুম ভেটু দিল। কাইয়ুমের ইচ্ছা কিছু টাকা মেরে দিবে। কারণ ঐ লোকের এতো টাকা লাগবে না। মোটামুটি দুইটা ভাগ হয়ে গেল গ্রুপ। এক গ্রুপ পুরা টাকা দিবে আরেক গ্রুপ পুরা টাকা দিবে না। অনেক আলোচনার পরে ঠিক হইল আমরা সবাই সদরঘাট যাব। লোকটাকে খাবারদাবারসহ লঞ্চে তুলে দিয়ে আসবো। এর মধ্যে আমরা হোটেলে সবাই মিলে নাস্তা খেয়ে নিব। বুদ্ধি আসল কাইয়ুম আর কালামের মাথা থেকে। ওদের দুইজনের মধ্যে একজনের বাড়ি বরিশাল আরেকজনের বাড়ি ঝালকাঠি। দুইজনের লঞ্চের ভাড়াসহ সবই জানে। সবাই মিলে দুইটা বেবিট্যাক্সি ঠিক করে ফেললাম।
বেবিট্যাক্সিতে উঠতে যাব এমন সময় লোক ব্যাকে বসলো। উনি আমাদের কাছে টাকা চায় কিছুতেই বেবিট্যাক্সিতে উঠবেন না। তিনি একা একা যাবেন। আমরা কিছুতেই তাকে একটা যেতে দিতে রাজি না। আর আমাদের মনে পুরাপুরি সন্দেহ চলে আসলো লোকটা বাটপার। হঠাৎ লোকটা আমরা কিছু বুঝে উঠার আগেই দিল দৌড়, দৌড়ে হাওয়া। আমরা হতবম্ভ হয়ে একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
কিছুক্ষণ পর অবশ্য আমাদের ভালই লেগেছিল। কারণ পুরো টাকাটাই আমাদের পকেটে…
২
এ্যালিফেন্ট রোডে কাক-এ মাত্র জয়েন্ট করেছি। অফিসে ঢোকার পরে প্রধান খাবার ছিল আলুর ভর্তা ডাল আর ডিম ভাজি। একদিন অফিস থেকে দোকানে যাচ্ছি ডাল আর ডিম কেনার জন্য। পথে এক ছেলে দাড় করালেন, ‘ভাই খুব বিপদে পড়েছি। আমি বরিশাল বিএম কলেজে পড়ি। আমার সব টাকা হারিয়ে গেছে। আমাকে একটু সহযোগিতা করেন।
মাত্র কিছুদিন আগে আমি নিজেও অভুক্ত ছিলাম। নতুন চাকরী পাওয়ার পর মনে হয়েছে নতুন জীবন খুঁজে পেয়েছি। ছেলের কথায় ইমোশনাল হয়ে গেলাম। শওকত ভাই তিনশ টাকা দিয়েছিলেন এই মাস চলার জন্য। মাসের মাঝখানে ঢুকেছিলাম তাই তিনশ টাকা দিয়েই হয়ে যাওয়ার কথা। আমি পকেটে একশ টাকার একটা নোট নিয়ে বের হয়েছি। বললাম আমার কাছে ভাঙ্গতি নেই আপনে দোকানে চলেন বাজার করার পর যা থাকবে পুরাটাই আপনাকে দিয়ে দিব। ছেলেটি নানারকম যুক্তি দিয়ে বলার চেষ্টা করলেন তার একশ টাকা পেলে অনেক উপকার হয়। আমি তো অপারগ, উনাকে একশ টাকা দিয়ে দিলে আমার নিজেরই সমস্যা হবে।
আমি সমস্যা বুঝিয়ে বললাম, তবুও সে নাছোড়বান্দা টাকা তার লাগবেই। কি মনে করে সন্দেহ হল, বললাম ঠিক আছে আপনে দোকানে চলেন। দোকানে যাওয়ার পর দোকান থেকে কাগজ-কলম নিলাম, বললাম আপনার নাম ঠিকানা এই কাগজে লিখেন। তিনি কাগজে নাম ঠিকানা লিখলেন। আমি বললাম অপেক্ষা করেন আপনে আমার সঙ্গে অফিসে যাবেন অফিস থেকে টাকা দিব। ছেলেটি কাগজটি হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ভাই আপনে জিনিশপত্র কেনেন আমি একটু সামনে থেকে আসতেছি।
আমি বাজার করে ছেলেটির জন্য অনেক্ষণ অপেক্ষা করলাম। কিন্তু সে আর ফিরলো না…
এমন বহু মানুষই প্রায়ই রাস্তায় দাড় করিয়ে কিছু বলতে চায়। আমি নিজের কাজে চলে যাই।
৩
৬৪ জেলা সাইক্লিং শেষে ঢাকায় ফিরেছি। আবার কাক-এ জয়েন্ট করেছি। থাকি নাখাল পাড়ায়, অফিস লালমাটিয়া। প্রায় প্রতিদিনই অফিস শেষে বাসায় ফিরি একা একা। মাঝে মাঝে নাসিফ আমিন ভাই থাকেন। যেদিন নাসিফ আমিন ভাই থাকেন ঐদিন রিক্সায় যাই। ফার্মগেট ৪০ টাকায় বিরিয়ানি খাই। তারপর আবার রিক্সায় নাখাল পাড়া। পূর্ব নাখাল পাড়া পর্যন্ত রিক্সা নেয়া হয়, আমি পশ্চিম নাখাল পাড়ায় নেমে যাই। নাসিফ আমিন ভাই পূর্ব নাখাল পাড়ায় যান।
একদিন নাসিফ আমিন ভাই নাই। আমি একা একা হেঁটে যাচ্ছি। একা গেলে বিজয় সরণী রজনীগন্ধা মার্কেটের সামনে খোলা আকাশের নিচে এক দোকানে খাই। মুরগী দিয়া বিরিয়ানি খেলে ত্রিশ টাকা গরু দিয়া খেলে চল্লিশ টাকা। খাওয়া-দাওয়া শেষে উঠতে যাব এমন সময় এক লোক আমাকে থামালেন। বয়স ৪০/৪৫ হবে। থামিয়েই সরাসরি বললেন, ‘বাবা সারাদিন কিছু খাই নাই, আমাকে চারটা ভাত খাওয়াইতে পারবেন?’ অনেকদিন পর একজনকে পেলাম যে খাইতে চাইছে। সাধারণত সবাই বলে দুইটা টাকা দেন ভাত খামু। কেউ সরাসরি বলে না ভাত খাবে। আমি লোকটাকে নিয়ে হোটেলে ঢুকলাম। খাবার দিতে বললাম। লোকটি দুই প্লেট খেলেন। গল্প করতে করতে জানতে পারলাম বাড়ি ময়মনসিংহ। জিজ্ঞেস করলাম বাড়ি যাবেন কিভাবে? আপনার কাছে তো টাকা নাই। লোকটি বলল, ‘বাবা ট্রেনে উঠলে চলে যেতে পারব, ট্রেনের ছাদে করে। অথবা টিটিরে কমু টাকা নাই। কি আর করবো পকেটে দেখবো, টাকা তো সত্যি নাই।’
অনেকদিন পর একজন সত্যিকারের বিপদে পরা মানুষ পেয়েছিলাম…