স্কুলে ক্লাস ওয়ানে ক্লাস করছি প্রায় সাত দিন হয়ে গেলো। বাসায় ফেরার পর বড় বোন জিজ্ঞেস করলেন, ‘এতদিন যাবৎ ক্লাস করতেছো, এখনো কোন বন্ধু বানাতে পার নাই?’ আসলেই এই কয়দিনে আমি কোন বন্ধু বানাতে পারিনি। তবে স্কুল খুবই ভালো লাগতো। স্কুলে যেয়ে সব সময় চুপচাপ বসে থাকতাম। বোনের কথাতে নিজের কাছে খারাপ লাগলো আসলেই তো, এটা একটা কথা হলো এখনো কোন বন্ধু বানাতে পারলাম না।
পরদিন স্কুলে যাওয়ার পর প্রথম কাজ বন্ধু বানাতে হবে। কাকে বন্ধু বানাবো বুঝতে পারছিলাম না। সবাই যে যার মতো করে বন্ধু বানিয়ে ফেলেছে, পেছনের দিকের বেঞ্চে দুইজনকে পেলাম। স্কুলের ইউনিফর্ম ময়লা, অন্য কারও সঙ্গে কথাও কম বলে। ওদেরকে সবাই ভয় পায় কারণ ওরা শুধু মারামারি করে। একজনের গালে আবার কাটা দাগ আছে। দুইজনের মধ্যে একজনের নাম রুবেল আরেকজনের নাম ইমতিয়াজ। কেনো জানি ওদেরকে খুব পছন্দ হলো, সরাসরি গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম তোরা আমার বন্ধু হবি? উত্তরে দুইজনেই সামান্য ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। কারণ ওদেরকে সবাই ভয় পায় মারামারি করার জন্য। তবে আমার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলো। আমরা তিন জন একজন আরেকজনকে তুই তুই করে বলি। একজন আরেকজনকে দোস্ত দোস্ত বলি (বন্ধুদের নাকি দোস্ত বলতে হয়
); ঠিক করলাম আমরা তিনজন একসঙ্গে স্কুলে আসবো একসঙ্গে স্কুল থেকে বাসায় ফিরবো। বাসা থেকে স্কুল খুব বেশি দূরে না। তবে ওদের অনেক সাহস ওরা দুই জনই একা একা আসে, কিন্তু আমাকে আমার এক দূরসম্পর্কের মামাতো বোন নিয়ে আসে।
পরদিন রুবেল আর ইমতিয়াজ আমার বাসায় হাজির, আমরা একসঙ্গে স্কুলে যাব। আমরা তখন থাকতাম পশ্চিম নাখালপাড়ার একটি দোতলা বাড়িতে। বাড়ির নাম আলেক মঞ্জিল, বাসার নম্বর ছিল ১৩৫; আমার বোন চুল সিঁতি করে করে দিচ্ছে, তারপর পায়ে পেগাসাস জুতা পরিয়ে দিচ্ছে। সেই জুতায় আবার বাতিও জ্বলে। তখন পেগাসাস জুতা মানে অনেক বড় কিছু। বোন আমাকে সাজুগুজু করানোর মাঝখানে দুই বন্ধুর সাক্ষাৎকারও নিয়ে নিলেন। কার বাবা-মা কি করে, কয় ভাইবোন ইত্যাদি। সাক্ষাৎকারে বের হয়ে আসলো রুবেলের বাবা রিক্সা চালায়, মা বাড়িতেই থাকে। আর ইমতিয়াজের বাবা নেই, কোথায় আছে সে জানে না। মা বিভিন্ন বাড়িতে কাজ করে, আমরা যাকে বুয়া বলি।
আমি ওদেরকে এই ধরনের কোন প্রশ্নই জিজ্ঞেস করিনি, জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনও মনে করিনি অথবা আমার মাথায় কখনো আসেই নি, এইসব জিজ্ঞেস করতে হয়। বোন তখন আর আমাকে কিছুই বলেনি। কিন্তু স্কুল থেকে ফেরার পর খুব বকাঝকা করেছিলো এবং হুসিয়ার করে দিয়ে বলেছিলো আমি যেন আর কখনো ওদের সঙ্গে না মিশি। সাহসের অভাবে তাঁকে জিজ্ঞেস করতে পারিনি কেন ওদের সঙ্গে মিশতে পারবো না। আমি আর কখনো ওদের সঙ্গে মিশি নাই।
একটু বড় হওয়ার পর দেখেছিলাম রুবেল টেম্পুর হেলপারি করছে, আরো কয়েকদিন পরে দেখলাম সে টেম্পুর ড্রাইভার হয়ে গেছে। একদিন জিজ্ঞেসও করেছিলাম, কিরে কেমন আছিস? আমাকে চিন্তে পারেনি। আমিও আর কিছু বলিনি, আমাকে না চেনাটাই ভালো। আমার মতো বন্ধুকে মনে না রাখাই ভালো। ইমতিয়াজকে আর কখনো খুঁজে পাইনি, জানি না কোথায় আছে? আমার প্রথম বন্ধুগুলা এভাবেই হারিয়ে গেছে।
আমি দুঃখিত হারিয়ে যাওয়া বন্ধুরা
আমি এখনও তোমাদের খুঁজি
স্মৃতির পাতায়…
এখন ভাবি, কাজ তো কাজই। এর মধ্যে খারাপের কি আছে? শিশুদের কেন পরিবারের নিজেদের মতামত এভাবে চাপিয়ে দেয়া হয়?
সবার ভালবাসায়, শিশুর আনন্দ মেলায়, স্বর্গ নেমে আসুক।
রেনেসাঁ
আজ যে শিশু
পৃথিবীর আলোয় এসেছে
আমরা তার তরে
একটি সাজানো বাগান চাই।।
আজ যে শিশু
মায়ের হাসিতে হেসেছে
আমরা চিরদিন
সেই হাসি দেখতে চাই
রেল লাইনের পাশে নয়
অন্ধকার সীড়িতেও নয়
প্রতিটি শিশু মানুষ হোক
আলোর ঝর্ণা ধারায়।
শিশুর আনন্দ মেলায়
স্বর্গ নেমে আসুক।।
হাসি আর গানে ভরে যাক
সব শিশুর অন্তর
প্রতিটি শিশু ফুলেল হোক
সবার ভালবাসায়
শিশুর আনন্দ মেলায়
স্বর্গ নেমে আসুক।।
