
ভাই গিরিশচন্দ্র সেন আমাদের কাছে কোরআন শরীফের অনুবাদক হয়েই বেঁচে আছেন। আমার কাছে একটি কোরআন শরীফের অনুবাদ আছে। অনুবাদটি হরফ প্রকাশনী, এ-১২৬ কলেজ স্ট্রীট মার্কেট, কলকাতা-৭ থেকে প্রকাশিত এবং ইংরেজি ১৯৯৩ সালে পুনর্মুদ্রিত। সেখানে শ্রীসতীকুমার চট্টোপাধ্যায় লিখিত ভাই গিরিশচন্দ্রের একটি জীবনী পেলাম। জীবনে পড়ে শুধু মুগ্ধই হয়েছি। জীবনীটি ছিলো সাধু ভাষায় এবং কিছুটা বড়ও, আমি মূল কথাগুলো রেখে এখানে চলিত ভাষায় ছোট্ট করে তাঁর জীবনীটি তুলে ধরার চেষ্টা করলাম। তিনি কোরআন শরীফ অনুবাদ ছাড়াও বেশ কিছু অনুবাদ করেছেন এবং বেশকিছু পত্রিকাও সম্পাদনা করেছেন। তিনি জীবনের অনেকটা সময় পড়াশোনা করে কাটিয়েছেন।
ভাই গিরিশচন্দ্রের জন্ম ইংরেজি ১৮৩৫ সালে তৎকালীন ঢাকা জেলার অন্তর্গত মহেশ্বরদি পরগণায় পাঁচদোনা গ্রামে। বর্তমানের কথা হিসেব করলে নরসিংদী জেলার মনোহরদী থানার পাঁচদোনা গ্রামে। নবাব আলিবর্দী খাঁর দেওয়ান দর্পনারায়ণ রায়ের বংশে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতার নাম মাধবরাম রায়। ভাই গিরিশচন্দ্রের দশ বছর বয়সে তাঁর বাবা মারা যান। তাঁরা ছিলেন তিন ভাই ও দুই বোন। গিরিশচন্দ্রের মায়ের বয়স যখন ৯৪ তখন তিনি মারা যান বৈশাখ মাসের বাংলা ১৩০৪ সালে।
গিরিশচন্দ্রের সাত বছর বয়সে পিসামহাশয়ের কাছে ফার্শি ভাষা শিক্ষা আরম্ভ করেন। বার বছর বয়সে কুলগুরু তাঁকে শিবমন্দ্রে দীক্ষা দেন। কয়েকবছর পরে তাঁর বড় ভাই থাকে ঢাকায় নিজের কাছে নিয়ে আসেন এবং ইংরেজি শিক্ষার জন্য পোগোজ স্কুলে ভর্তি করে দেন। ইংরেজি শিখতে অনিচ্ছা প্রকাশ করায় গিরিশচন্দ্রকে ঐ স্কুল বাদ দিয়ে মোনসী কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের কাছে ফার্শি সাহিত্য শিক্ষার জন্য ব্যবস্থা করা হয়। তাঁর বয়স যখন ১৮/১৯ তখন তাঁর ছোটদাদা তাঁকে নিজের কাছে অর্থাৎ ময়মনসিংহে নিয়ে আসেন এবং এক মৌলবীর কাছে উচ্চ ফার্শি সাহিত্য শিক্ষার ব্যবস্থা করে দেন। পাশাপাশি স্থানীয় কাছারিতে নকলনবীশীর কাছে নিযুক্ত করেন কিন্তু তিনি সে কাজ পছন্দ করেননি।
তখন তিনি নতুন করে স্থানীয় পাঠশালায় সংস্কৃত শিক্ষা আরম্ভ করেন। পাঠশালায় তিনি ভালো করতে শুরু করলেন। প্রশংসার সঙ্গে পরীক্ষায় পাশ করে তিনি হার্ডিঞ্জ স্কুলে সাধারণ শিক্ষায় প্রবৃত্ত হন। সেই পরীক্ষায় সসম্মানে পাশ করে করে প্রথমে হার্ডিঞ্জ বঙ্গ-বিদ্যালয়ে এবং পরে ময়মনসিংহ স্কুলে দ্বিতীয় পন্ডিতের কাজে নিযুক্ত হন। পাঠশালায় তাঁর রচনাশক্তি প্রকাশ পায়। তখন শিক্ষকতার সঙ্গে তিনি রীতিমত সাহিত্যচর্চাও আরম্ভ করেন। ‘ঢাকাপ্রকাশ’ পত্রিকায় তিনি সংবাদ ও প্রবন্ধ লিখতে থাকেন। ঐ সময় তিনি ‘বনিতা বিনোদ’ নামে একটি কবিতা বইও বের করেন।
এতদিনে তিনি যে ফার্শি সাহিত্য শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন তাও এখন তাঁর সাহিত্যচর্চার বিষয় হয়ে উঠে। ফার্শি ভাষায় লিখিত সেখ শাদীর ‘গোলোস্তান’ পুস্তকের বাংলা অনুবাদ করে ‘হিতোপাখ্যানমালা’ বইটি প্রকাশ করেন। এই বইটি শিক্ষাবিভাগ কর্তৃক পাঠ্যরূপে নির্বাচিত হয়েছিলো। দিনে দিনে তাঁর ভিতর সাহিত্যচর্চার সঙ্গে সমাজসেবার ভাব প্রস্ফুটিত হয়। দেশে তখন নারীশিক্ষার অনেক অভাব ছিলো। এক ধনীর সাহায্যে তিনি একটি অবৈতনিক মহাবিদ্যালয়েয় গঠন করেন ও সেখানে নিজেই বিনা বেতনে মহিলাদের শিক্ষা দিতে থাকেন।
(চলবে)
