মর্যাদা নিয়ে বাঁচা

চলার পথে নানারকম ঘটনা ঘটে। সামনে একটা গল্প এসে দাঁড়া হয়। প্রতিবারই ভাবি অফিসে গিয়ে অথবা বাসায় গিয়ে লিখবো। কিন্তু আর হয়ে উঠে না।
আজ ধানমন্ডি ৮ নাম্বার ব্রিজের কাছের ঘটনা এটা। পার্কের পাশে একটা ট্রাক এসে লোকজনের কাছে কম দামে জিনিশপত্র বিক্রি করে। যেটা সরকারের টিসিবির গাড়ি। মালামাল বিক্রির আগে থেকেই বিশাল লাইন ধরে। একপাশে পুরুষরা আরেকপাশে মহিলারা। মহিলাদের লাইনটাই সব সময় বড় হয়। এই রকম গাড়ি বিভিন্ন জায়গায় নির্দিষ্ট সময়ে প্রতিদিন জিনিশপত্র বিক্রি করে। মোটামুটি প্রত্যেকটা জায়গার একই রকম চিত্র দেখি। ঘটনাগুলাও মোটামুটি একই রকম। লাইনে দাঁড়ানো নিয়ে সব সময় ঝগড়া হয় একজনের সাথে আরেকজনের। অনেক সময় এই ঝগড়া মুখের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। হাতাহাতিতে পৌঁছে যায়।
আমার যেদিন সময় থাকে না সেদিন এক পলক দেখে চলে যাই। মাঝে মাঝে সময় থাকলে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি কোন কারণ ছাড়া। মানুষগুলাকে দেখি।
একই লাইনে বিভিন্ন রকম মানুষ। মহিলারা সাথে করে বাচ্চাদেরও নিয়ে আসে। সকল মানুষদের মধ্যে কিছু মানুষকে আলাদা করা যায়। সংখ্যায় একটু কম। কিন্তু এরা ঝগড়া করে না, চুপচাপ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে। বোরখা পরে আসে, কেউ কেউ হয়তো বোরখা ছাড়াও আসে।
আমি দেখেই বুঝতে পারি, নিজেকে কেন জানি রিলেট করতে পারি। খুব অনিচ্ছায় এই মানুষগুলা এখানে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। বেঁচে থাকতে হবে, কম টাকায় কিছু জিনিসপত্র নিতে হবে, তাই বাধ্য হয়ে এই লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। এই লাইন, এই চরিত্রগুলা গত কয়েকবছর ধরেই দেখতেছি। নিজের লজ্জা বিসর্জন দিয়ে, বোরখায় নিজেকে লুগিয়ে এই মায়েরা নিজের সংসারের জন্য একটা সংগ্রাম করে যাচ্ছে।
আমি যখন তৃতীয়/চতুর্থ শ্রেণি থেকে মোটামুটি মা মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত এই লজ্জার মধ্যে দিয়ে যেতে হইত। প্রতিদিন আম্মার সাথে ফকিন্নির বাজারে যেতে হইত। আমাদের নাখালপাড়ার আসেপাশে দুইটা বাজার ছিল। বিকালের পরে রেললাইনে মূল বাজার বসতো। সকালে নাবিস্কোর কাছে বাজার বসতো সেটাকে আমরা সকালের বাজার বলতাম।
এর বাইরে তেজগাঁও স্টেশনের কাছে ফকিন্নির বাজার নামে একটা বাজার বসতো। ফকিন্নির বাজার নামটা ডাকা হইত কারণটা তখন না বুঝলেও এখন বুঝি। বস্তির পাশের বাজার, সমাজের সবচাইতে নিচু শ্রেণির মানুষরা সেই বাজারে বাজার করতো। বাজারটা মূলত কাওরানবাজারের ফেলে দেয়া জিনিশপত্রে চলতো। ফেলে দেয়া বলতে ট্রাক থেকে মালামাল নামানোর সময় অনেক সবজি পড়ে যেত, কিছু সবজি বের হইত একটু নষ্ট। সেগুলা মহিলারা কুরিয়ে নিয়ে আসতো। ভালোগুলো তো স্বাভাবিকভাবেই বিক্রি হইত, একটু নষ্টগুলা নষ্ট অংশগুলা কেটে ফেলে দিয়ে ভালো অংশগুলা বিক্রি করতো।
আম্মা প্রতিদিন বাজারে যেত আমাদের নিয়ে যেত। কিন্তু আমরা কেউ যেতে চাইতাম না, আবার আম্মাকে একটু ভয়ও পেতাম, ভয়ের কারণেই যেতে হইত। আমরা দুই ভাই নিজেরা ঠিক করে রেখেছিলাম, একদিন ছোট ভাই যাবে একদিন আমি যাব। নিজের দিনটা চলে গেলে হাফ ছেড়ে বাঁচতাম। যাক আগামী দিন তো আমার যেতে হবে না। জিনিসপত্র নিয়ে ফেরার সময়, সারাক্ষণ মনে মনে আল্লাহর কাছে দোয়া করতাম। ‘আল্লাহ পথে যেন কোন বন্ধু-বান্ধবের সাথে দেখা না হয়।’ দেখা হলে কিযে একটা লজ্জার বিষয়!
কিন্তু দুঃখের বিষয় আল্লাহ বেশিরভাগ সময়ই আমাদের কথা শুনতো না।
এই ট্রাকগুলার সামনে দিয়ে গিলেই কেন সেইসব দিনের কথা মনে পড়ে। শৈশবের বেশিরভাগ সময়ই গেল এই লজ্জার মধ্যে দিয়া। নিজেকে লুকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টাতেই বেশিরভাগ সময় গেছে। ট্রাকের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা মায়েদের, বাচ্চাগুলার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে থাকি!
আহা আমরা একটু মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য কত কিছুই না করি!
১৬ পৌষ ১৪৩১

Comments

comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.