মেরাজ ভাইয়ের সাথে পরিচয় সম্ভবত ২০১৪/২০১৫ সালের দিকে। খুব ভোরবেলা চারুকলার ছবির হাটে অপেক্ষা করছিলাম গাড়ির জন্য। তাঁর হাতে কিছু গাছ ছিল। আমরা অর্জুনায় যাব। কিন্তু কেউ কাউকে চিনি না। কিছুক্ষণ পরে গাড়ি আসার পরে দেখি আমরা একই পথের যাত্রী।
এরপরের ট্রিপ ছিল সম্ভবত হাওরে। তখন হাওর এত বিখ্যাত ছিল না। আমরা নেত্রকোনা দিয়ে ঢুকে কিশোরগঞ্জ দিয়ে বের হয়েছিলাম। এরপরে আমরা কুয়াকাটা, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁওসহ অনেক জায়গায় ঘুরেছি।
আমাদের ঘোরাঘুরিগুলো ছিল একটু অন্য রকম টাইপের। সবার সাথে মিলত না। তাই প্রথম প্রথম গ্রুপের সাথে গেলেও শেষের দিকে আমরা দুইজনেই ঘুরতাম। যেমন দেখা গেল আমরা ঠাকুরগাঁওয়ে সিনেমা দেখতে গেলাম। বিরিশিরিতে ঘুরতে গেছি কিন্তু ৩০ কিলোমিটার দূরে গিয়ে সিনেমা হল খুঁজে বের করে সিনেমা দেখছিলাম মফস্বলে।
ঢাকায় বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে ঘুরতে গিয়ে সার্কাস দেখছিলাম। পথে অর্থহীন বিষয়ও আমাদের কাছে ইন্টারেস্টিং লাগত। দেখা গেল কেউ ওষুধ বিক্রি করছে কিন্তু সে আবার দোতরা বাজিয়ে গান গায়, আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গান শুনতাম। শেষে আবার ওই মানুষগুলোর সাথে গল্প করতাম। তাঁদের জীবনের গল্প শুনতাম।
এই টাইপের বিষয়গুলো বেশিরভাগ মানুষের হয়তো ভালো লাগত না। কিন্তু আমাদের কাছে এইগুলিই ছিল ঘুরাফেরার মানে। আমরা লোকজনের ইন্টারভিউ নিতাম, ছবি তুলতাম, ভিডিও করতাম। এসবের বাইরেও আমাদের অনেকগুলো কাজ ছিল।
একদিন হুট করে মেরাজ ভাই বললেন, আমাদের ঘুরাঘুরির একটা নাম দাও তো। তখন সম্ভবত আমি রাহুলের বইপত্র পড়ছিলাম। নাম দিলাম, ভবঘুরে। আমরা যেহেতু লোকজনের সাথে প্রচুর গল্প করি, তাঁদের কথাবার্তা শুনি, জীবনের গল্প শুনি, তাই সঙ্গে লেজুড় দেওয়া হল জীবনের পাঁচালী…
হঠাৎ করে কেন জানি আস্তে আস্তে আমাদের মধ্যে যোগাযোগ কমে গেল। এক সময় বন্ধ হয়েই গেল। কেন বন্ধ হয়ে গেছে সম্ভবত আমরা দুইজনের কেউই জানি না। আমার এই রকম অনেক কিছুই হয়। কোন কারণ ছাড়াই এমন হয়। হয়তো তাঁরও এমন কোন রোগ ছিল।
তিনি নিজের নামের বানান লিখতেন অদ্ভুতভাবে—মূর্শেদূল কাইয়ুম মেরাজ। হুট করে আবার আমাদের মাঝে যোগাযোগ শুরু হল। মাসখানেক আগেই শেষ কথা হয়েছিল। তিনি বেশ কিছুদিন হলো ঢাকা শহর ছেড়ে লালনের আখড়ায় চলে গেছেন। আমাকে দাওয়াত দিলেন যাওয়ার জন্য। কথা দিয়েছিলাম যাব, ঘুরে আসব।
কিন্তু সেই ইচ্ছাটা আর পূরণ হল না। আর কী লিখব বুঝতে পারছি না। তাঁর সাথে অনেক অনেক স্মৃতি। আমাদের অনেক লেখা আছে প্রকাশ হয়নি। হয়তো কোনো একদিন প্রকাশ হবে। হয়তো বা না।
তার এই চলে যাওয়াতে জীবনানন্দের কয়েকটি লাইন মাথায় ঘুরছিল…
“হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল-সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে।” (বনলতা সেন)
অথবা
“অবশেষে সব পাতা ঝরে যায়,
সব ফুল মরে যায়,
সব প্রেম ফুরায়।” (অবশেষে)
কিন্তু এই শেষের লাইনটা কেন জানি আমার ক্ষেত্রে কাজ করে না। আমার কোনো প্রেমই ফুরায়নি। যে চলে গিয়েছে, তাঁর প্রতি প্রেম গাঢ় থেকে আরো প্রগাঢ় হয়…