‘র’ নামের এক বন্ধুর গল্প

এলাকায় নতুন এক ছেলে আসলো। ছেলেটা তেমন কারও সঙ্গেই মিসে না। প্রথম প্রথম এসেছে বলেই হয়তো। আমরা তখন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি। আমাদের স্কুলেই পড়ে। আমি পড়ি ‘খ’ শাখায় ছেলেটা ‘গ’ শাখায়। ছেলেটার মধ্যে এক ধরনের স্মার্টনেস আছে। বিশেষ করে পোষাক আসাকে আর নিশ্চুপতায়। আমি তখন ১০/১২ টাকা দামের স্যান্ডেল পড়ে স্কুলে যাই। আর ছেলেটা সুন্দর ক্যাডস পড়ে স্কুলে যায়, গলায় একটা পানি খাওয়ার ফ্ল্যাক্স ঝুলানো থাকে, ব্যাগটাও সুন্দর। আর আমি স্কুলে যাই ব্যাগ ছাড়া শুধু বইপত্র হাতে নিয়ে। কিভাবে কিভাবে যেন একদিন পরিচয় হয়ে গেল। নামের প্রথম অক্ষর ‘র’ (ইচ্ছে করেই পুরা নাম বলছি না)।

পরিচয়ের পর আস্তে আস্তে আমাদের সবার সঙ্গেই মেশা শুরু করলো। সবার সঙ্গে মিসলেও কথা বলতো খুবই কম। ‘র’ ছিল ওর ডাক নাম। পুরা নাম আমার ওর নাম একই শরীফুল ইসলাম। কিন্তু ঐ নামে ওকে কেউ চেনে বলেও মনে হয় না। ওরা দুই ভাই, দুই ভাইয়ের নামের প্রথম অক্ষরই ‘র’ দিয়ে। বড় জনের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব আর ছোট জনের সঙ্গে ছোট ভাইয়ের বন্ধুত্ব। ওরা থাকতো আমাদের পাশের বাসার বিল্ডিংয়ের একটি ফ্ল্যাটের নিচ তলায়। ওর মা সারাদিন বাসায় থাকতো না। প্রথম প্রথম অবাক হয়ে ওর মার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। কারণ ওর মা প্রতিদিন সকালে অনেক সাজুগুজু করে বের হতো। সাজগোজও দেখার মত। পরে জানতে পেরেছিলাম ওর মা ফিল্মে কাজ করে।

ওর বাবা ছিল না। ফ্ল্যাট বাসায় থাকতো ওরা দুই ভাই, মা, খালা-খালু আর খালাতো ভাইবোন। আর একজন লোক থাকতো ওরা সবাই আঙ্কেল বলে ডাকত। কৌতূহলবসত একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম বাবার কথা বলেছিল মারা গেছে। কিন্তু পড়ে কার কাছে যেন শুনেছিলাম ওর বাবা ওদের ছেড়ে চলে গেছে। আর যে লোকটিকে ওরা আঙ্কেল বলে ডাকে তাঁকে ওর মা বিয়ে করেছে। এটা নিয়ে ওর মধ্যে এক ধরনের কষ্ট ছিল বুঝতাম কিন্তু কখনো কিছু জিজ্ঞেস করতাম না। ওরা আমাদের এলাকায় প্রায় বছর দুই/তিন ছিল।

এই দুইতিন বছরে প্রায়ই ওদের বাসায় যেতাম। ওর মা যেহেতু ফিল্মে কাজ করতো, আমরা নতুন নতুন মুভি দেখতাম। নতুন কোন মুভি দেখলেই আমাকে ডেকে নিয়ে যেত। আমাদের এলাকাতেই সূচনা নামে একটা ভিসিআরের দোকান ছিল সেই দোকান থেকে ভিসিআরের ক্যাসেট ভাড়া করে নিয়ে আসত। একটা ছবির কথা এখনও মনে আছে, সালমানশাহর ‘সত্যের মৃত্যু নেই’। সেই ছবিতে ওর মা অভিনয় করেছিল। স্কুলে লম্বা ছুটি দিলে (যেমন গরমের ছুটি, ঈদের ছুটি) আমরা দুইজনে বের হয়ে যেতাম। উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটতাম। দুইজনে মিলে এক ধরনের খেলা খেলতাম। যেমন কোরবানী ঈদে গরু গুনা। একবার হাঁটতে হাঁটতে গাবতলী চলে গেলাম, যেয়ে তো মাথা খারাপ এত গরু গুনবো কিভাবে? তখন ঠিক করলাম হাটের গরু গুনা যাবে না। পথে যেগুলো দেখা যায় সেগুলাই গুনবো।

এক সময় ওরা পশ্চিম নাখালপাড়া ছেড়ে পূর্ব নাখাল পাড়া চলে গেল। পূর্ব নাখাল পাড়া থাকতো একদম মোস্তফা সরওয়ার ফারুকীর পাশের বাড়িতে। তখন সরওয়ার ফারুকী বিখ্যাত কেউ না। এলাকায় এডিকটেড হিসেবে নাম ছিল। ওই বাসায়ও মাঝে মাঝে যেতাম, আমরা এক ঈদে ঠিক করলাম ঈদ কার্ডের ব্যবসা করবো। ঈদে ঈদ কার্ডের ব্যবসা করলাম। ওই বাসা ছেড়ে ওরা চলে গেল বেগুনবাড়ি। তখন দেখা হতো খুবই কম। একদিন হঠাৎ সে এলাকায় হাজির আমাকে বলল, ‘শরীফ একবার বেগুনবাড়ি যাবি?’ আমার উত্তর কেন? তার উত্তর ‘একজনরে খুব পছন্দ হইছে, দেখতে একদম শাবনুরের মতো, চোখগুলা অন্যরকম কেমন জানি, বেড়ালের চোখের মতো।’ সত্যি সত্যি একদিন গেলাম দেখতে।

বেগুনবাড়ির বাড়িও একসময় ছেড়ে দিয়ে ওরা আবার ফিরে আসলো নাখালপাড়ায়। ততদিনে আমরা কিছটাু বড় হয়েছি। সারাদিন ক্রিকেট নিয়ে পড়ে থাকি। ‘র’ ভাল খেলত, আমাদের দলের ওপেনিং বলিং এবং ওপেনিং ব্যাটিং করতো। নাখাল পাড়া ফেরার পর জানতে পারলে আঙ্কেলের সঙ্গে ওর মার বিচ্ছেদ হয়েছে। আমাদের আট দশবছরের বন্ধুত্বে সে কখনই এইসব কথা তুলতো না, আমিও কোনদিন তুলতাম না। কিন্তু সবই জানতাম, মাঝে মাঝে অনেক কথা বলত আমি শুধু শুনতাম কোনদিন কিছু বলি নাই। কিন্তু অনুভব করতাম একটা মানুষ ঐ অল্প বয়স থেকে নানা রকম ভাঙ্গাগড়া নিয়ে জীবন চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা যখন দুইজন হাঁটতাম তখন কেউ কারও সঙ্গে কথা বলতাম না ঘণ্টার পর ঘণ্টা। বুঝতে পারতাম ছেলেটা ঘণ্টার পর ঘণ্টার দিনের পর দিনের মনের মধ্যে যুদ্ধ করে চলছে।

আমার বন্ধুর সংখ্যা খুবই কম। বিশেষ করে সমবয়সী বন্ধু তেমন নাই। সব বন্ধুই ছোট অথবা বড়। যাদের সঙ্গেই ভাল বন্ধুত্ব হয়েছে প্রতিটা মানুষেরই ব্যক্তি জীবনে এই ধরনের সমস্যা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। প্রতিটা মানুষই নিজের অনেক কথা উজাড় করে বলতো। আরও মজার বিষয় এই মানুষগুলাই ব্যক্তি জীবনে অসাধারণ কিছু সৃষ্টিশীল কাজ করে যাচ্ছে। নতুন নতুন ধারণা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, নতুন নতুন চিন্তা করতে পছন্দ করে। নতুন কিছু করতে চায়…

এই ধরনের বন্ধুগুলার এত এত গল্প নিজের ভিতর জমে আছে যা শেষ হয় না… কিন্তু কারও পুরা নামই আমি বলতে পারবো না। আবার অনেক গল্পও বলতে পারবো না।

১৮ শ্রাবণ ১৪২২

Comments

comments

Comments

  1. রূপা

    আমরা মানুষরা খুব আজব। যদিও এখন আর এগুলা নিয়ে ভাবতে ভালো লাগে না। কিন্তু, দীর্ঘ জীবনে চুপচাপ পাশাপাশি হেঁটে যাওয়া বন্ধু চেয়েছি, পেয়েছিও আবার পাইনিও। লেখাটা পড়ে কেমন হাহাকার জেগে উঠে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.