লজ্জা

অনেকদিন পরে লিখতে বসলাম। প্রায়ই ভাবি কিছু লিখবো কিন্তু লেখা হয় না। আজকে যে বিষয়টা নিয়ে লিখছি সেটার বিষয় লজ্জা। তসলিমা নাসরিনের লজ্জা না। নিজের জীবন থেকে লজ্জা থেকে মুক্তি পাওয়ার গল্প বলা যায়।

ছোটবেলায় কোন কিছু পারি না বলতে অনেক লজ্জা লাগতো। না পেরেও অথবা না জেনেও একটা ভাব দেখাতাম জানি। কিন্তু একটা মানুষের পক্ষে সবকিছু জানাটা খুবই কঠিন একটা ব্যপার। এই বিষয়গুলা আস্তে আস্তে জানতে পেরেছি। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। এই বিষয়টা ছোটবেলাতে জানতে পারলে হয়তো ভালো হতো। আরো কিছুদূর এগিয়ে যাওয়া যেত। এই লজ্জা থেকে একজন অপরিচিত মানুষ আমাকে মুক্ত করেছেন। তাঁর নাম-ধাম কিছুই জানি না।

কাকে ঢুকার পরে প্রথম দিকে দুইটা কোর্স পেয়েছিলাম। একটা ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স। আরেকটা চিত্রনাট্য রচনা কর্মশালা। এর আগে সলিমুল্লাহ স্যারের একটা কোর্স চলছিল। এই কোর্সগুলা শেষ হওয়ার পরে আস্তে আস্তে কাকের অবস্থা একটু একটু খারাপ হতে লাগলো। এক সময় কাকের সকল কর্মীদের ছাটাই করে শুধু আমাকে রাখা হলো।

কিছুদিন পরে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র থেকে ছেড়ে একজন আসলেন সকল দায়িত্ব নেয়ার জন্য। তিনি নকীব ভাই। পুরা নাম ‘ইমদাদুল হক সুফী’ আমি যদি ভুল না করে থাকি। আমরা সবাই নকীব ভাই বলেই ডাকতাম। নকীব ভাই অফিসে এসেই সবকিছু পাল্টে ফেলা শুরু করলেন। কাক পুরাপুরি সচল হয়ে গেল। প্রতিদিনই কোন না কোন কোর্স লেগেই থাকে।

ছোট ছোট নানারকম কোর্স হতো। একদিন দুইদিন তিনদিন করে ছোট ছোট কোর্সগুলা হতো। এই কোর্সগুলার বেশিরভাগ লোকজনের সঙ্গেই পরিচয় হওয়ার সুযোগ ছিল না। কিন্তু বড় কোর্সগুলো যেহেতু তিনমাস জুড়ে হইত তাই তাঁদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে যেত।

এই রকম কোন একটা ছোট কোর্সে এক লোক আসছেন কোন একটা মফস্বল শহর থেকে। ক্লাসের মাঝেই তিনি প্রথমে টয়লেটে ঢুকেছেন তারপর কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসছেন। ভাই আলাদা করে ডেকে নিয়ে আবার টয়লেটে নিয়ে গেলেন। বললেন, ‘ভাই এই টয়লেটে কিভাবে বসে? আমি তো আগে কখনো এই টয়লেট দেখি নাই। আপনে কি আমাকে একটু শিখিয়ে দেবেন এখানে কিভাবে টয়লেট করতে হয়?’ টয়লেটটা ছিল হাই কমড, তাঁর কাছে এইটা একদমই নতুন।

তাঁর এই প্রশ্নটা আমাকে একটা ধাক্কা দিল। আমি কখনো কাউকে এভাবে বলতে দেখি নাই, বা শেখার জন্য এভাবে বলতে দেখি নাই। খুবই সহজ সরল ভাষায় প্রশ্নটা করেছেন। তিনি যে জানেন না এর জন্য তাঁর মধ্যে এতটুটু লজ্জা নেই। আমার কাছে তাঁর এই বিষয়টা প্রচণ্ড ভালো লাগলো। আমার কাছে মনে হইল না জানাটা লজ্জার কিছু না। বরং তাঁর মতো প্রশ্ন করে জেনে নেয়াটা বরং খুবই ভালো এবং যথেষ্ট আনন্দ দায়কও বটে।

কাকে ঢুকার কিছুদিনের মধ্যেই ঠিক করলাম একটা ব্যাংক একাউন্ট খুলবো। তখন মোরশেদ ভাইয়ের সঙ্গে কাজ করতেন আসাদ ভাই। আসাদ ভাইকে বলাতে তিনি ডাচবাংলায় একাউন্ট খুলার পরামর্শ দিলেন। সঙ্গে বলে দিলেন অবশ্যই যেন কার্ড নিয়ে নেই। তাঁর কথামতো ব্যাংক একাউন্ট খুলার সময়ই কার্ডের জন্যও আবেদন করলাম। চেক বইয়ের পাশাপাশি কার্ড সংগ্রহ করলাম। তখন আমার কাছে কার্ড মানেই হইল ক্রেডিট কার্ড। কিন্তু কার্ডের মধ্যে যে নানা রকম ভাগ আছে সেটা জানতাম না। কার্ড ব্যবহারেরও অনেক পরে এসে বুঝতে পারলাম কার্ড বিষয়ে নানারকম প্রকারভেদ আছে। ডেভিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড পুরাই আলাদা জিনিশ। কিন্তু কোনটা কি তা জানতাম না।

একদিন রাব্বি ভাইয়ের কাছে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ভাই মাস্টার কার্ড, ডেভিড কার্ড, ক্রেডিট কার্ড এই বিষয়গুলা আমাকে একটু বুঝিয়ে বলেন তো।’ রাব্বি ভাই মোটামুটি ২০ মিনিট ধরে আমাকে খুব সন্দরভাবে মোটামুটি ব্যাখ্যাসহকারে বুঝিয়ে দিলেন কোনটার কি কাজ। আমিও মাঝে মাঝে প্রশ্ন করে আরো খুঁটিনাটি বিষয় জেনে নিয়েছিলাম।

আমার কাছে এভাবে প্রশ্ন করে জেনে নেয়ার বিষয়টা খুবই ভালো লাগে। আর না জানাটা কখনোই অপরাধ হতে পারে না, লজ্জারও কিছু নাই।

সেই না জানা ভাইয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা অসীম।

১৫ ফাল্গুন ১৪২৫

Comments

comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.