লাশ ভয়ঙ্কর

মানুষ মারা গেলেই লাশ। মানুষ মারা যাবে এটাই স্বাভাবিক। কিছু কিছু মৃত্যু আছে অস্বাভাবিক। আমার জন্ম নাখাল পাড়ায়। নাখাল পাড়া এলাকার মধ্য দিয়ে রেললাইন। রেললাইনের এক পাড়ের নাম পশ্চিম অন্য পাড়ের নাম পূর্ব। নাখালপাড়ায় বেশ কিছু অস্বাভাবিক মৃত্যু দেখতে হয়েছে। এলাকাটা একসময় সন্ত্রাসীদের আড্ডা ছিলো। তাই ছোট বেলাতেই বোমাবাজি মারামারি দেখতে দেখতে বড় হয়েছি।

আমি দ্বিতীয় কি তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি। কার কাছে যেন শুনলাম রেললাইনে এক্সিডেন্ট হয়েছে। বেশ আগ্রহ নিয়ে দেখতে গেলাম। একজন পুরুষ মানুষের লাশ। ট্রেনের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে সঙ্গে সঙ্গেই মৃত্যু। মাথা থেকে চামড়া সরে গেছে, রক্তে রঙ্গিন মাটি। এই দৃশ্য দেখে সেই দিন রাতে ঠিক মতো ঘুমাতে পারলাম না। বোনকে জড়িয়ে ধরে থাকতে হয়েছে। রাতে টয়লেটে যাওয়ার জন্য বোনকে ডেকে তুলে তারপর টয়লেটে যেতে হয়েছে। এই রকম দৃশ্য দেখা ছিলো সাধারণ ঘটনা, প্রায়ই ঘটতো। বেশির ভাগ ঘটনাই ঘটত রাতে। কারণ সন্ধ্যার পর রেললাইন কেন্দ্র করে বাজার বসতো। বাজারে শত শত মানুষ বাজার করতে যেত।

তবে দিনের বেলায় পাগলারপুলে কিছু ঘটনা ঘটতো। লোকজন বলতো পাগলারপুল এলাকাটা অশুভ। তাই সেখানে লোকজন খুব যেত না। আমার ধারণা সেখানে লোকজন কম যেত বলেই সেখানে যে লোকজনগুলো মারা যেত বেশির  ভাগই ছিল আত্মহত্যার ঘটনা। কারণ সেখানে বাধা দেয়ার কেউ থাকতো না। সন্ধ্যার দিকে বাজারে এমন কিছু ঘটনাও ঘটেছিলো মানে আত্মহত্যার ঘটনা। কিন্তু অনেক সময় সফল হতো না যারা আত্মহত্যা করতে যেত। কারণ বাজারে অনেক লোকজন থাকতো, কেউ না কেউ চেষ্টা করতো তাদের বাঁচাতে।

ট্রেনে কাটা লাশগুলো দেখতে অনেক ভয় লাগতো। তারপরেও কেন জানি খুব ইচ্ছা করতো দেখতে। তাই ভয় লাগলেও দেখতে যেতাম। ট্রেনের দুর্ঘটনা ছাড়াও আরেকটা ভয়ঙ্কর লাশ আমাকে দেখতে হয়েছিলো। সেটা ছিলো খুন। আগেই বলেছিলাম এলাকায় মারামারির ঘটনা ছিলো স্বাভাবিক। এখন অবশ্য অনেক শান্ত। একদিন অনেকের কাছে শুনতে পারলাম রেললাইনে একটা খুন হয়েছে। শত শত মানুষ ছুটে যাচ্ছে খুন হওয়া ব্যাক্তির লাশ দেখার জন্য। আমিও গেলাম। তখন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি, আমার উচ্চতা লোকজনের কোমরের সমান। সবাইকে ঠেলেঠুলে ভেতরে ঢুকলাম এবারের অভিজ্ঞতাও ভয়ঙ্কর। যাকে খুন করা হয়েছে তার মাথায় গুলি করা হয়েছে। মাথা মোটামুটি দুই ভাগ হয়ে গেছে। মুখে তুলা ঢুকানো। দুই হাত ও পায়ের রগ কাটা এবং হাত-পা বাধা, ভয়াবহ দৃশ্য।

ঐ ছোট্ট বয়সে সবচাইতে ভয়াবহ যে দৃশ্যটি আমার দেখতে হয়েছিলো। যেই ঘটনা আমি কখনোই ভুলবো না। এক লোক ট্রেনে কাটা পড়েছে। বয়স ৭০ এর উপরে হবে। এমন ভাবে কাটা পড়েছে যে, চেহারা বুঝা মুশকিল। একদম ট্রেনের মাঝখানে পরেছে। তাঁর শরীর আর শরীর নাই। ৭০ এর বেশি টুকরা হবে। টুকরা টুকরা হতে হতে অনেক দূর পর্যন্ত গিয়েছে লাশ। একটা জায়গায় বেশিরভাগ অংশ জরো হয়েছে। কিন্তু অনেক দূরে যেহেতু দূর্ঘটনাটি ঘটেছিলো সেহেতু ছোট ছোট টুকরাগুলো অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়েছিটিয়ে ছিলো। ঐ বয়সে কোত্থেকে সাহস আসলো জানি না, টেম্পুর হেলপার একটা ছিলো নাম রুবেল। ও কোত্থেকে যেন হুইল সাবানের একটা কার্টুন নিয়ে এসেছে, এক হাতে হুইল সাবানের কার্টুন আরেক হাতে কাঠি। কাঠি দিয়ে মাংসের ছোট ছোট টুকরোগুলো কার্টুনে ঢুকাচ্ছে। আমিও ওর পেছন পেছন যোগ দিলাম।

ঐ দিনের ঘটনার পর থেকে কেন জানি লাশ দেখলে আর ভয় করে না। তবে মার মৃত্যুর পর আমি আর কখনো কৌতুহলী হয়ে লাশ দেখতে যাই না। তবে লাশ দাফনের কাজে খুব আগ্রহ নিয়ে যাই। অনেকদিন পরে এসে রানা প্লাজায় ঐ রকম কিছু লাশ দেখতে হয়েছিলো।

এই ধরনের ঘটনার মতো আরো অনেক ধরনের অভিজ্ঞতা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি আর আমার অবাক হওয়ার অনুভূতি আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে।

এখন কোন মৃত্যুর ঘটনা শুনলেই বলি, ‘ও আচ্ছা।’

এই লেখা লেখার কোন কারণ নাই, কি মনে করে লিখছি তাও জানি না। ইচ্ছা হইছে তাই লিখলাম…

Comments

comments

Comments

  1. A Hasan

    লিখতে থাকো শরিফ ভাই…

    1. 🙂

      ভাই আপনার সঙ্গে অনেকদিন দেখা হয় না।

      1. ভাই, দেখা করব আর কয়েকদিন পর… তোমার লেখা আমি নিয়মিতই পড়ি… লেখা চালায় যাও… evidence রাখার দরকার আছে… 🙂

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.