চলার পথে নানারকম মানুষের সাথে পরিচয় হয়। কেউ কেউ টিকে থাকে কেউ কেউ হারিয়ে যায়। আবার অনেকে হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলা ফিরেও আসে। আবার ফিরে এসেও হারিয়ে যায়।
মানুষের সঙ্গে মানুষের পরিচয়ের নানারকম মাধ্যম আছে। আগে অথবা এখনো পরিচয়ের প্রধান মাধ্যম শুরু হয় সামনাসামনি ভাবেই। যেমন স্কুলে গিয়ে ক্লাশে পরিচয়। এলাকায় হয়তো খেলতে গিয়ে পরিচয়। নতুন কোথাও চাকরীতে ঢুকে পরিচয়। কাজের মাধ্যমেও নানা রকম মানুষদের সাথে পরিচয় হয়।
এর বাইরেও আরো কয়েকটা মাধ্যম আছে পরিচয়ের। যখন মোবাইল প্রথম প্রথম আসলো তখন দেখা গেছে অপরিচিত মানুষজনের সঙ্গে মানুষের পরিচয় হতো। এর আগে শুনেছিলাম টিএনটি ফোনে রং নাম্বার অথবা ক্রস কানেকশনের মাধ্যমে পরিচয় হতো।
এর পরে ইন্টারনেটের দুনিয়ায়ও নানা রকম মাধ্যমে মানুষের সাথে মানুষের পরিচয় হয়, বন্ধুত্ব হয়। লাসমির সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল ফোনেই বলা যায়। মাধ্যম হিসাবে ছিল বাপ্পি। বাপ্পির মাধ্যমেই লাসমির সঙ্গে প্রথম কথা হয়। প্রথম কয়েকদিন কথাবার্তা হয়েছিল কিন্তু কখনো দেখা হয় নাই।
আমি তখন এলিফ্যান্ট রোডে কাজ করি। তখন ঘুম থেকে উঠতাম দেরিতে প্রায় ১১ টায়। কারণ অফিস শুরুই হতো ১২ টার দিকে। একদিন হঠাৎ সকালের দিকে লাসমির ফোন। অপরিচিত একটা নাম্বার থেকে ফোন দিয়ে বলল, ‘ভাইয়া তুমি ফার্মগেট আসো। আমি এখানে আছি।’ লাসমির তখন নিজের ফোন ছিল না। বেশিরভাগ সময় ওর মার ফোন থেকে ফোন দিত। লাসমির ভাই সেই ফোন থেকে কল লিস্ট বের করে আমাকে ফোন দিল। লাসমি বাসা থেকে বের হয়ে গেছে ওকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
আমাকে সব খুলে বলার পরে আমি তাঁদের আস্বস্ত করলাম যে চিন্তা না করতে। কথা দিলাম লাসমিকে নিয়ে আমি আসতেছি। ফার্মগেট যাওয়ার পরে প্রথম লাসমির সঙ্গে দেখা, এই প্রথম দেখা। লাসমি প্রথমে সম্ভবত নাখালপাড়া গিয়েছিল তারপর সেখান থেকে ফার্মগেট আসছে সঙ্গে এক বন্ধু। এর মধ্যে কিছুক্ষণ পর পরই ওর মা অথবা ভাই ফোন দিচ্ছে। লাসমির সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে কিনা, কখন ওকে বাসায় দিয়ে যাব। ওর সঙ্গে একবার কথা বলতে চায়।
আমার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর পরই ওর ভাই আর মার সঙ্গে কথা বলাইলাম। তারপর ওকে নিয়ে রওনা দিলাম মতিঝিলের উদ্দেশে। সেখানেই পৌঁছে দেয়ার কথা।
তখন লাসমি মাত্র ক্লাস নাইনে পড়ে। ছাত্রী হিসাবেও অসাধারণ। ঐ বয়সে এই সাহস কোত্থেকে পেল সেটা একটা রহস্যই ছিল। তবে সেই রহস্য ভাঙ্গতে বেশি সময় লাগে নাই। কথাবার্তা বলে বুঝতে পেরেছিলাম এই মেয়ে হুমায়ূন আহমেদ ছাড়া অন্য কোন বইপত্র পড়ে না। হুমায়ূন আহমেদের বই পড়তে পড়তে সে একটা ফ্যান্টাসির মধ্যে বসবাস করে। সেই ফ্যান্টাসি থেকেই এই কর্ম।
এখন নিশ্চয়ই লাসমির ঐ কথা মনে পড়ে হাসি পাবে।
আমরা ফার্মগেট থেকে একটা দোতলা বাসে করে মতিঝিল গিয়েছিলাম। এর মধ্যে কিছুক্ষণ পর পর ফোনে আপডেট দিতে হচ্ছিল আর কতক্ষণ লাগবে কোথায় আছি। নানা রকম অবিশ্বাস আমি কি সত্যিই ওকে দিয়ে আসবো।
মায়ের মন সাধারণত এমনই হয়। এর মধ্যে আবার ওর বড় ভাই নিজে নিজে বিয়ে করে ফেলেছিল। তাই উৎকণ্ঠা থাকাটাই স্বাভাবিক। যদি মেয়ে একটা ভুল করে ফেলে? আমাদের সমাজে ছেলের ভুল হয়তো মেনে নেয়া যায়। কিন্তু মেয়ের ভুলটা ঐভাবে মেনে নেয়া যায় না।
এক সময় আমরা মতিঝিল পৌঁছালাম। বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে ওর মা এবং ভাইয়ার কাছে দিয়ে আসলাম। তাঁরা একটা রিক্সায় করে চলে গেল। কিন্তু ওর মা আমাকে গোপনে প্রায়ই ফোন দিত। এইটা লাসমিকে ঐভাবে বলতাম না। লাসমিও কিছুদিন পর পর ফোন দিত। আমাকে বাসায় যাওয়ার জন্য চাপাচাপি করতো। আর বাসা থেকেও ওকে কোথাও বের হতে দিত না। সব সময় পাহাড়া দিয়ে রাখতো। কোথাও গেলে মা সঙ্গে নিয়ে যেত। এভাবে চাপাচাপি করতে করতে একদিন ওদের বাসায় যাওয়ার দিনতারিখ ঠিক হলো।
কিভাবে কিভাবে যেতে হবে আগেই বলে দিয়েছিল। আমি সাইকেল নিয়ে চলে গেলাম নারিন্দায়। নারিন্দা মঠের উল্টা পাশে একটু সামনেই দোতলায় ওরা ভাড়া থাকে। আসল বাড়ি নারায়ণগঞ্জ। এখানে থাকে শুধু মাত্র ওর পড়াশুনার জন্য। বুঝতে পারলাম টাকা-পয়সার দিক দিয়ে বেশ স্বচ্ছল। হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসের কোন এক চরিত্রের মতই।
ওদের বাসায় বেশ কিছুক্ষণ ছিলাম। লাসমির সঙ্গে, আন্টির সঙ্গে, ভাবির সঙ্গে নানারকম গল্পগুজব করলাম। দুপুরে খাওয়াদাওয়া করে তারপর ফিরলাম।
লাসমির সঙ্গে সব মিলিয়ে এই দুইবারই দেখা। এর পরে হঠাৎ করেই কিভাবে কিভাবে যেন যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেল। আর কখনো কথাবার্তা হয় নাই। ও মার যে নাম্বারটা ছিল সেটাও বন্ধ ছিল।
অনেকদিন থেকেই ভাবতেছিলা লাসমির এই চরিত্রটা নিয়ে একদিন লিখবো। কিন্তু সময় সুযোগ হয়ে ওঠে না। এর মধ্যে দুইদিন অন্যান্য পুরানা মানুষদের মধ্যে লাসমির নাম দিয়ে ফেসবুকে সার্চ দিয়েছিলাম কিন্তু পাই নাই। এবার সত্যি সত্যি পেয়েছি। কিন্তু এতদিন আগে মাত্র দুইদিন দেখার স্মৃতির উপর বিশ্বাস রাখতে পারতেছিলাম না। ঐখানে কয়েকটা ভিডিও দেখে ওর গলা শুনে মনে হলো এটাই হয়তো লাসমি হবে।
লাসমি এখন অনেক দূরে আমেরিকা নামে একটা দেশে থাকে।
ফেসবুকে ম্যাসেজ দিলাম, ‘আপনে কি কখনো নারিন্দায় ছিলেন? আর বাড়ি নারায়ণগঞ্জ?’ উত্তর আসলো ‘হ্যাঁ।’
আমার সম্বন্ধে কিছুই মনে নাই। তবে দুইটা বিষয় মনে আছে দেখা গেল। সেটা হইল আমি আগে নিয়মিত নিজের ডিজাইনকৃত ক্যাপ-টিশার্ট পরতাম। এই বিষয়টা লাসমির ঠিক মনে আছে।
বাচ্চা একটা মেয়ের যে এই একটা বিষয় মনে আছে এটাই বা কম কি!
১৮ কার্তিক ১৪২৬
