লুলু স্যার

আজ যাকে নিয়ে লিখছি তিনি লুলু স্যার। প্রথমেই নাম নিয়ে হয়তো একটা ধাক্কা লাগবে। আমি নিজেও প্রথমে একটা ধাক্কা খেয়েছিলাম। এটা আবার কেমন নাম? তাঁর নাম কি আসলেই লুলু! এর উত্তর অবশ্য স্যারের কাছে সরাসরি জিজ্ঞেস করে জানা হয় নাই। কোন একজনের কাছে শুনেছিলাম আসল নাম এনামুল হক। কতটুকু সত্যি জানি না। নামের ‍বিষয় বাদ দেয়া যাক।

হঠাৎ স্যারকে নিয়ে লিখতে ইচ্ছা করলো কেন? কারণটা অনেকদিন পরে আজ স্যারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। অনেকদিনের চাইতে কয়েক বছর বলাটাই মনে হয় ভাল। স্কুলের পড়াশুনা এবং একাডেমিক পড়ালেখার মধ্যে স্কুলের বাইরে আমার তেমন কোন শিক্ষক নেই। এই একজনই বলা যায়। এর কারণ স্কুলের বাইরে আমি কোথাও কোচিং অথবা কোন গৃহশিক্ষকের কাছে পড়ি নাই। আমার পড়াশুনা সবই স্কুল কেন্দ্রিক ছিল। অন্তত নবম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার আগে স্কুলের বাইরে আমার কোন শিক্ষকই ছিল না। একমাত্র এই লুলু স্যারের কাছেই পড়া হয়েছে। এর বাইরে যদি আমার কোন শিক্ষক থেকে তাঁরা হলো আমার বন্ধুরা। আর স্কুল শেষ না করে তো পড়ালেখাই ছেড়ে দেয়া হয়েছিল তাই শিক্ষকের তো প্রশ্নই আসে না।

স্যারের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল এক বড় ভাই ফুয়াদ ভাইয়ের মাধ্যমে। ফুয়াদ ভাই আমাদের গলিতেই থাকতেন। এক সঙ্গে একই ক্লাবে ক্রিকেট খেলতাম। একদিন ফুয়াদ ভাই স্যারের বাসায় নিয়ে গেলেন পরিচয় করিয়ে দিলেন, পরদিন থেকে পড়তে যাওয়া শুরু। সেখানে গিয়ে স্কুলের বন্ধু শাকিলকে পেয়ে গেলাম। এ ছাড়াও অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেল আস্তে আস্তে।

নাইনে ভর্তি হওয়ার আমার নিজের খুব ইচ্ছা ছিল আর্টস নিয়ে পড়বো। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই বয়স অল্প হলে নিজের ইচ্ছার খুব একটা মূল্য থাকে না। তখন দেখতাম বন্ধুরা গণহারে কমার্স নিয়ে পড়াশুনা করছে, কি মনে করে আমিও ঠিক করলাম কমার্স নিয়ে পড়বো। কিন্তু বাসা থেকে বাবার একটা আলাদা বাসনা ছিল, সেটা হলো আমি যেন বিজ্ঞান নিয়ে পড়ি। বাবা কোনদিন স্যারের সঙ্গে দেখা করতে যান নাই। কিন্তু এই বাসনার কারণে লুলু স্যারের বাসায় একদিন বাবা হাজির হলেন। এই প্রথম এই শেষ। স্যারকেই প্রশ্ন করলেন, ‘আমি তো ছেলেকে সাইন্স নিয়া পড়াতে চাই। আপনে কি বলেন?’ স্যারও দেখলাম বাবার সঙ্গে তাল দিলেন, ‘ওর তো মাথা পরিষ্কার, ও বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে পারবে।’ কিন্তু বিজ্ঞান নিয়ে পড়া মানে মুখে বলে দিলে হয়ে গেল না। এর জন্য আলাদা শিক্ষকেরও দরকার। কারণ আমি কিছুই বুঝি না।

আমার ইচ্ছার বাইরে গিয়েই বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে হলো। স্যারের কাছে মূলত অংক আর ইংরেজি পড়তাম। কিন্তু স্যার মাঝে মাঝে পদার্থর অংকসহ বিজ্ঞানের অনেক কিছুই দেখিয়ে দিতেন কিছুদিন পর পর। এখনও মনে আছে তখন উচ্চতর গণিত পড়তাম বন্ধু তপুর কাছে। তপু অবশ্য আমার চাইতে এক বছরের ছোট ছিল, কিন্তু আমি পড়ালেখায় খুব একটা সুবিধার ছিলাম না। তাই তপু পড়াশুনায় আমার চাইতে এক বছরের বড় ছিল বলা যায়। কিন্তু আমরা তুমি তুমি করেই সমম্বোধন করতাম। এমনকি স্যারের বাসায় যাঁদের সঙ্গে পড়তাম মোটামুটি বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রী বয়সে কিছুটা ছোট হলেও সবার সঙ্গেই তুমি তুমি বলে সম্বোধন করতাম। একমাত্র আমার পুরানা ক্লাশের বন্ধু শাকিলদের মতো কেউ থাকলে তুই তুই করে সম্বধোন করতাম।

এদিকে পরিবার থেকে তো বলেই খালাশ। কিন্তু সংসারে নানা রকম সমস্যা লেগে থাকতো। স্যারকে সবাই মাসে ৫০০ টাকা সম্মানী দিত। সেখানে আমি দিতাম ৩০০ টাকা। এটা নিয়ে আমার প্রচণ্ড লজ্জা লাগতো। আমরা সবাই টাকা দিতাম খামে ভরে। কেউ জানতো না আমি যে ৩০০ টাকা দেই একমাত্র স্যার আর আমি জানতাম। স্যারের কাছে যখন প্রথম পড়তে যাই তখনও টাকা নিয়ে খুব একটা দর কষাকষি হয় নাই, আসলে টাকা নিয়ে কোন কথাই হয় নাই। স্যার ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কটা পড়ালেখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন। এই একটা জায়গার কারণে স্যারের প্রতি আলাদা একটা শ্রদ্ধা কাজ করতো।

প্রথম কয়েকমাস নিয়মিতই সম্মানী দিতে পেরেলিছাম। কিন্তু একটা সময় নিয়মিত দিতে পারতাম না। খুবই খারাপ লাগতো। দেখা গেছে দুইমাস তিনমাস পর পর ৫০০ টাকা দিতাম। কিন্তু তবুও একটা সময় এই বিষয়টা নিয়ে প্রচণ্ড মন খারাপ হতে থাকলো। বাসায় দেখা গেছে এইটা নিয়ে কিছুটা শীতল কথাবার্তাও বলেছি। স্যার কোনদিন এই বিষয় নিয়ে একটা কথাও বলেননি। এই না বলাটাকেও আসলে কেন জানি আমি চাপ মনে করতাম।

একদিন আম্মা স্যারের বাসায় হাজির হলেন। এর আগে কখনো স্যারের বাসায় আসেন নাই, এই প্রথম এই শেষ বলা যায়। স্যারকে সমস্যার কথা বলাতে। স্যার খুব ভালমতই বললেন, এটা নিয়ে যেন আমি কোনদিন মন খারাপ না করি। আমি যেন আমার মত পড়াশুনা চালিয়ে যাই। অর্থনৈতিক বিষয়টা পরিবার আর স্যারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকাই ভাল। সত্যি কথা বলতে কি এই রকম মানুষ পাওয়া অবশ্যই কঠিন। যেই মানুষটা দিনের পর দিন শুধু শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন কিন্তু কোনদিন কিছু চাচ্ছেন না।

আমি তখন বন্ধু এমদাদের ভাইয়ের দোকানে কাজ করি। পড়াশুনা বন্ধ বলা যায়। স্যার প্রায়ই দোকানে আসতেন ফ্ল্যাক্সিলোড করার জন্য। একদিন কথায় কথায় বললেন আমি যেন কোন একটা সরকারী চাকরীতে ঢুকে যাই। কোন একটা পিয়নের চাকরী পেলেও অন্তত আমার জীবনটা নিয়ে খুব একটা চিন্তা করতে হবে না। একটা সিকিওরিটি আসবে জীবনে। স্যার আমাকে নিয়ে খুবই ভাবতেন। স্যার এমনও বলেছেন স্যার নিজে চেষ্টা করতে চান। ঢুকার জন্য কোথাও যদি টাকা-পয়সাও দিতে হয় সেটাও স্যার কিছুটা সহযোগিতা করবেন। কিন্তু এই সরকারী চাকরী আমাকে কোনদিন আকর্ষণ করে নাই। এর জন্য সম্ভবত স্যার আমার উপর কিছুটা মনোক্ষুন্ণও হয়েছিলেন।

কিন্তু কেন জানি এই বিষয়টা আমাকে খুব একটা আকর্ষণ করে নাই। আমি সরকারী চাকরী একটা পেয়েছিলামও বলা যায়। তিতাসের আন্ডারে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জ্বলানাী উপদেষ্টার অফিসে ৫/৬ মাস কাজও করেছিলাম। কিন্তু এই চাকরীটা আমাকে একদমই টানে নাই। হয়তো ৫/৬ মাসের আরো কিছুদিন করলে স্থায়ীভাবে সরকারী কাজ করতে পারতাম। আমার ভবিষ্যতের জন্য হয়তো খুবই ভাল হতো। কিন্তু কেন জানি একদমই ইচ্ছা করে নাই। আমি সেই চাকরী কোন রকম চিন্তাভাবনা ছাড়াই ছেড়ে দিয়েছিলাম। এই বিষয়টা নিয়ে বাবা থেকে শুরু করে অনেকেই দুঃখবোধ করেন।

আজ অনেকদিন পরে স্যারের সঙ্গে দেখা করে পুরানো দিনের কথাগুলা মনে পড়ে গেল। স্যারের বাসায় কতই না দুষ্টামি করেছি। দেয়ালে লেখা থেকে শুরু করে টেবিলে কত কিছুই লিখেছি। আজ হঠাৎ স্যারের দেয়াল দেখে মনে হলো আমরা এখনো সেই নাইনে পড়ি। স্যার আমাদের সামনে বসে পড়াচ্ছেন। আগের মতই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নিয়ে পড়াচ্ছেন। এখনও স্যার ঠিকই পড়াচ্ছেন আগের মতই। তবে নতুন ছাত্র-ছাত্রীদের।

স্কুল জীবনে কমপক্ষে ২০/৩০ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা পেয়েছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় দুইচারজন ছাড়া বেশিরভাগ শিক্ষকেরই নাম মনে নাই। দুয়েকজন শিক্ষক ছাড়া আমাকে কোন স্যারই খুব একটা আকর্ষণ করতে পারে নাই। এর বাইরে স্কুলের পড়ালেখার বিষয়ে এই একজন শিক্ষকের কাছে পড়েছি। আর এই একজনকে কখনই ভোলা সম্ভব না। বলতে হবে আমি খুবই ভাগ্যবান এমন একজন শিক্ষক পেয়েছিলাম। যেই মানুষটার মধ্যে পড়ালেখার বাইরেও ছাত্রদের সঙ্গে আলাদা একটা সম্পর্ক আছে। ছাত্র-ছাত্রীরা খোঁজ-খবর না নিলে মনে মনে মন খারাপ করেন। অন্যান্য অনেক শিক্ষকদের মতো শুধু টাকার সম্পর্ক তৈরি করেন না। দুঃখ করে বলেন না অমুকে তো আমাকে আর মনে রাখলো না। এই রকম শিক্ষক যদি আমরা আরো অনেক পেতাম তাহলে খুব ভাল হতো।

স্যারকে নিয়ে হয়তো আরো অনেক কিছু লিখতে হবে একসময়। আপাতত এই পর্যন্তই…

১৫ বৈশাখ ১৪২৫

Comments

comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.