লেখালেখি

আমার লেখালেখির শুরুটা হয়েছিল অদ্ভুত ভাবে। অনেকদিন পাঠাগারে যাওয়া বন্ধ ছিল, আম্মা মারা গেছেন। সব সময় মন খারাপ থাকে, রাস্তায় রাস্তায় কোন কারণ ছাড়াই ঘুরি। হঠাৎ একদিন পথে কাজীর সঙ্গে দেখা। কাজী মানে শরীফ কাজী। পুরা নাম শরীফ কাজী হলেও আমরা সবাই কাজীই ডাকতাম। শরীফ বাদ দিয়া কেন কাজী ডাকা হইত সেটা মনে নাই। কাজী স্কুলে আমার এক বছরের জুনিয়র ছিল প্রথম দিকে পরবর্তীতে আবার কাজী সিনিয়র। তারপরেও আমরা বন্ধুর মতই ছিলাম সব সময়। এমনকি টুকু আমার দুই বছরের ছোট তবুও দেখা গেছে টুকুর অনেক বন্ধুবান্ধবও আমার বন্ধু হয়ে গেছে। কারণ শেষের দিকে টুকু আর আমি একই ক্লাশে পড়তাম। ছাত্র হিশাবেও খুবই খারাপ ছিলাম, আর বারবার স্কুল ছাড়া। মনে আছে প্রথম শ্রেণি আর দ্বিতীয় শ্রেণি বাদ দিলে আমার রোল নাম্বার সবসময় একশর উপরে ছিল কোনদিন একশর নিচে নামে নাই।

কাজীর সাথে নতুন করে আবার ঘুরাফেরা শুরুর পরে আমরা একসাথে পাঠাগারেও থাকা শুরু করলাম। সুরাইয়ার সাথে পরিচয়ের মাধ্যম হিশাবেও কাজী মাঝখানে ছিল, অর্থাৎ কাজীর মাধ্যমেই সুরাইয়ার সাথে পরিচয়। পাঠাগার আর ঘুরাফেরা নিয়া আমাদের অনেক স্মৃতি আছে। কাজী তখন স্কুল পাশ করে মোহাম্মদপুরে ঢাকা স্টেট কলেজে ভর্তি হয়েছে। স্কুলে থাকা অবস্থাতেই কাজী একটা মেয়েকে পছন্দ করতো। মেয়েটার ছদ্ম নাম ছিল ‘পারি’। পারির সাথে কাজীর বিচ্ছেদ অথবা প্রেম এই দুইটার কোন কারণে কাজীর মাথার মধ্যে কবিত্ব ভর করে।

ঢাকা স্টেট কলেজ থেকে কাজীরা বসিলার দিকে ঘুরতে যেত। আমিও দুয়েকবার কাজীর সাথে বসিলার দিকে ঘুরতে গিয়েছিলাম। তখন বসিলা ব্রিজ মাত্র তৈরি হচ্ছে। এত বিল্ডিং ছিল না। পুরা এলাকা ছিল বালুময়। সেইসব ধুধু বালুর মাঠ, শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতি স্তম্ভ, পারির বিচ্ছেদ অথবা প্রেম সব একাকার করে বেশ কিছু কবিতা লিখেছিল। সেই কবিতার খাতাটা আমার কাছে প্রায় সপ্তাহ দুয়েক ছিল। যতদূর মনে পড়ে সেই কবিতার খাতাটার মলাট ছিল লাল।

সত্যিই মলাটটা লাল ছিল কিনা জানি না, হঠাৎ কেন চোখের সামনে লাল মলাটটা ভেসে আসছে তাও জানি না। হয়তো তখন আমরা সমাজ তান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট করতাম বলে লাল রঙটা মনের মধ্যে গেথে গেছে। কাজীর কবিতার খাতা হাতে পাওয়ার পরে আমার মনেও বাসনা জাগল আমিও কবিতা লিখব। আমারও তখন একসঙ্গে দুইটা বিচ্ছেদ মা মারা গেছে আবার স্কুলে যে মেয়েটার প্রেমে পড়েছিলাম সেই মেয়েটাও অন্যের সঙ্গে ঘর বেঁধেছে। মনে হইল বেঁচে থাকলে হয়তো এই কবিতার মধ্যেই বেঁচে থাকা যাবে। আর বেঁচে থাকা যাবে বিপ্লব করে।

কাজীর কবিতা দেখে দেখে আমিও বেশ কিছু কবিতা লিখে ফেললাম। সেই কবিতা অবশ্য কাউকে দেখাই নাই। ঐগুলা আসলে কিছুই হয় নাই। কাজীর কবিতার অনেকটা কপি হয়ে গিয়েছিল। প্রথম প্রথম যখন লিখেছিলাম তখন খুবই ভাল লাগছিল, মনে হইছিল বাহ! কি সুন্দর লিখে ফেলছি। পরবর্তীতে যখন আবার পড়েছিলাম তখন বুঝতে পারছিলাম এইটা খুবই হাস্যকর হয়েছে।

তারপরেও বলবো আমার লেখালেখি অনেকের মতো কবিতা দিয়েই শুরু।

এর পরে অনেকদিন আর কোনকিছু লিখি নাই। অন্যদের লেখাই কম্পোজ করে গিয়েছি। কম্পোজ শেখার জন্য টুকটাক রোজনামচা লিখতাম, সেটাকে ঐভাবে লেখা বলা যায় না। আমি শুধু পড়তামই লোকজনের লেখা। রাহাত ভাইয়ের ভ্রমণ বিষয়ক লেখা দেখে খুব ইচ্ছা জাগত ভ্রমণ বিষয়ক কিছু একটা লিখতে। আর রাব্বি ভাইয়ের লেখা পড়ে মনে হইত আসলে তো বিষয় আমাদের আশেপাশেই আছে। আমাদের জীবনের মধ্যেই কত গল্প লুকিয়ে আছে, চাইলেই লিখা যায়। রাব্বি ভাইকে আমি সত্যি সত্যি হিংসা করতাম, কবে যে এইসব হাবিজাবি বিষয় নিয়ে লিখতে পারবো। আর এভাবেই অন্যের লেখা অক্ষর বিন্যাস করতে করতেই একদিন কি মনে করে যেন শিবুদাকে নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলাম। তখন রাসেল ভাই থেকে শুরু করে কয়েকজন বলেছিলো লিখতে থাক। যা ইচ্ছা তাই লিখ।

এর পরে তো রাব্বি ভাই একটা ওয়েবসাইটই খুলে দিলেন, ‘লাইফ রাইড রান’ নাম দিয়া। আমিও দেখা গেছে স্মতিচারণ অথবা হাবিজাবি যা ইচ্ছা তাই লিখে যাচ্ছি। এই করোনার দিনে যে মানুষিক চাপ সেটা সামান্য হলেও কম লাগতেছে বলে মনে হচ্ছে।

বিশেষ দ্রষ্টব্য: কাজীর খাতায় শুধু ওর নিজের কবিতাই থাকতো না। অন্যদের বিশেষ বিশেষ কবিতার বিশেষ বিশেষ লাইনও থাকতো। সম্ভবত ওর প্রিয় কবিতার লাইনগুলাও লিখে রাখতো। যেমন এখন সবচাইতে যে দুইটা লাইন মনে পড়তেছে:

বন্ধু তুমি কেঁদোনা, আমারও কান্না আছে
কাঁদিনা তোমারি জন্য, তুমি ভেসে যাও পাছে।

কবিতার লাইনগুলা সম্ভবত কবির সুমনের। ফিডব্যাক ব্যান্ড একটা গানের আগে এই লাইনগুলা ব্যবহার করেছিলেন।

১০ বৈশাখ ১৪২৭

Comments

comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.