শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতি পাঠাগারের ৩০ বছর

এই পাঠাগারটিতে যখন যাওয়া-আশা করি তখন খুব সম্ভবত আমি দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ি। পাঠাগারটি লুকাসের মোড়ে তিনতলায় ছিল। দ্বিতীয় তলায় ছিল একটা শরীর চর্চা কেন্দ্র। দ্বিতীয় তলায় শরীর চর্চার আর তৃতীয় মানবিকতা চর্চা বিষয়টা বেশ মজার ছিল।

প্রথমদিকে আমার আকর্ষণ ছিল কমিক্সের প্রতিই। কমিক্স দিয়েই শুরু বলা যায়। তারপর বিভিন্ন বিষয়ের বইপত্রে ঘুরাঘুরি বলা যায়। পাশাপাশি পাঠাগারও এক জায়গায় থেমে ছিল না। আজ এই জায়গায় তো কাল ঐ জায়গায়। একটা সময় কাজী অফিসের পাসেও কয়েকবছর ছিল। আমরা নিয়মিত পাঠাগারের ছোট্ট জায়গাটায় ক্রিকেট খেলতাম। আর কাজী অফিসে বিয়ে হইলেই আমাদের এখানে মিষ্টি চলে আসতো।

বইপত্র পড়ার ক্ষেত্রে যেমন অস্থির ছিলাম, তেমনি পাঠাগারও কখনো স্থির ছিল না, কখনো স্থায়ী ঠিকানা পায় নাই। কতবার যে ঠিকানা বদল করেছে তাঁর হিশাব হয়তো শুরু থেকে থাকা আজাদ ভাই, চিশতী ভাই, নাঈম ভাইরা ভাল বলতে পারবেন। তবে কখনো নাখালপাড়ার বাইরে যায় নাই এই পাঠাগার। সব সময় নাখালপাড়াতেই ছিল। হয়তো কখনো পূর্ব নাখালপাড়ায় কখনো পশ্চিম নাখালপাড়ায়। কখনো ভাড়া করা বাসায় অথবা কখনো হয়তো কেউ দয়া করে কয়েকমাসের জন্য কারও বাসায় থাকতে দিয়েছিল আবার কয়েক মাস ম্যাসেও ছিল এই পাঠাগার। পাঠাগারের নিজস্ব একটা ভ্রমণও হয়ে গেছে বলা যায়।

আমি নিজেও যে পাঠাগারে প্রতিদিন গিয়েছি তেমনটাও না। কখনও দেখা গেছে প্রতিদিন গিয়েছি। আবার হয়তো অনেকমাস যাওয়াই হয় নাই। প্রথম দিকে যখন পাঠাগারে যাওয়া-আশা শুরু করি তখন পাঠাগারের নাম ছিল ‘শহীদ শহিদুল্লাহ কায়সার স্মৃতি পাঠাগার’। তারপর নাম পরিবর্তিত হয়ে ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতি পাঠাগার’। পাঠাগারের শুরুর ইতিহাসটাও হয়েছিল সম্ভবত একটা ক্রাইসিসের ভিতর দিয়ে। বড় ভাইয়ারা ১৯৮৮ বন্যায় সাধারণ মানুষকে সহযোগিতা করার জন্য চাঁদা তুলেছিলেন এলাকায়। সেখান থেকেই কারও মাথা থেকে পাঠাগার দেয়ার আইডিয়াটা আসে।

পাঠাগারের সঙ্গে আমার অন্য রকম একটা সম্পর্ক। এমন একটা সম্পর্ক যে পাঠাগারকে নিজের জীবন থেকে আলাদা করার কোন উপায় হয়তো খুঁজে পাব না। প্রচণ্ড দুঃসময়ে যখন কোথাও থাকার জায়গা ছিল না তখন চিশতী ভাইয়ের কাছে গিয়েছিলাম একটা সমাধানের জন্য। ম্যাসে উঠবো সেই পয়সাও ছিল না।

চিশতী ভাই-ই তখন বলেছিলেন, ‘আপাতত পাঠাগারে থাকো’। একটা চাকরী হওয়ার আগ পর্যন্ত পাঠাগারেই ছিলাম অনেকদিন। সঙ্গী ছিল আরেক শরীফ। শরীফ কাজী। আমরা সবাই কাজী বলেই ডাকতাম। কাজী থাকতো পড়াশুনা করার জন্য। ওদের ছোট্ট বাসায় অনেকে গাদাগাদি করে থাকতো পড়াশুনা করার অবস্থা ছিল না। তাই কাজীও পাঠাগারে থাকতো। মাঝে মাঝে অবশ্য আমাদের সঙ্গে কাজীর বন্ধু সুজন হালদার এসে থাকত। পাঠাগারের বইগুলা ছিল ১০০/২০০ পাতার তাই ঐ বইগুলা মাথায় দিয়ে ঘুমানো যেত না। আমরা একটু মোটা বই মাথায় দিয়ে ঘুমাতাম। সেই মোটাবইগুলা ছিল নজরুল রচনাবলী অথবা রবীন্দ্র রচনাবলী। বই যে শুধু পড়ার জিনিশ না মাঝে মাঝে মাথায় দিয়ে ঘুমানোর জিনিশ সেটা পাঠাগারে না ঘুমালে বুঝতে পারতাম না।

এই বছরে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতি পাঠাগারের ৩০ বছর হয়ে গেল। পাঠাগারের মতো একটা সংগঠন ৩০ বছর টিকে থাকা সাধারণ কোন কথা না। এর মধ্যে নাখালপাড়ায় বহু সংগঠন হারিয়ে গেছে। বহু সংগঠনের মৃত্যু দেখেছি কাছ থেকে।

হিশাব করে দেখলাম পাঠাগারের সঙ্গে আমার বয়সের পার্থক্য খুব বেশি না। মাত্র এক/দুই বছরের। ৩০ বছর পূর্তিতে অনেকদিন পর পাঠাগারে গিয়েছিলাম। পুরানো বন্ধুবান্ধব বড় ভাইদের সঙ্গে দেখা হয়েছে। খুব সুন্দর সময় কাটলো সবার সঙ্গে।

‘শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতি পাঠাগার’ আরো অনেক অনেকদিন টিকে থাক। অন্তত আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পাঠাগারটির মৃত্যু যেন না হয়। পাঠাগারের মাধ্যমে অনেক সুন্দর সুন্দর মানুষ তৈরি হৌক।

পাঠাগারের প্রতি এটাই আমার অন্তীম বাসনা…

১৭ চৈত্র ১৪২৫

Comments

comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.