আমি পড়াশোনা শেষ করার পর কোন চাকরিতে ঢুকিনি কারণ অন্য কিছু খুঁজছি কিন্তু এমন এক অবস্থা যে কোন কিছুই পাচ্ছিনা। যখন খুব মন খারাপ হয় তখন সবকিছুই কেমন কেমন জানি অগোছালো মনে হতে থাকে। এরি মাঝে একদিন ফোন আসল আমার স্কুল থেকে যেখান থেকে আমি পড়াশোনা করে আসছি।খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়ার কথা বলল। আমি আমতা আমতা করে রাজি হয়ে গেলাম। মন থেকে যেতে ইচ্ছে করছে না কারণ শহরের একটা টান বা অন্য কিছুও হতে পারে।
মে মাসের প্রথম দিন যোগ দেওয়ার কথা ছিল কিন্তু ঐদিন স্কুল ছুটি ছিল তাই মে মাসের ২ তারিখে যোগ দিলাম। প্রথম কোন স্কুলে ক্লাস নিতে যাচ্ছি। আমার কেমন কেমন যেন লাগছে। পরিচিত সেই স্কুল মাঠ, পরিচিত সেই বারান্দা, পরিচিত সব স্যার। স্যারদের বেশির ভাগ ছিল সরাসরি আমার শিক্ষক, সবার কাছে আমি ছাত্রী। প্রথমে কয়েকজন স্যার আমাকে দেখে অবাক হলেন। ঢাকায় পড়াশোনা করে গ্রামে আসছি কেন তার উত্তর দিতে দিতে আমার অবস্থা খারাপ। তাও আবার খন্ডকালীন !
প্রধান শিক্ষক সাহেব আমাকে নিয়ে ক্লাস নাইনে গেলেন। সবার কাছে আমার পরিচয় বললেন, আমি তো একটু চিন্তিত। কেমন করে শুরু করব বা কি দিয়ে শুরু করব। আমি তাদেরকে পড়ানো শুরু করলাম আর বললাম তোমাদের পরিচয় নিতে হবে না। আস্তে আস্তে সবার পরিচয় জানা হয়ে যাবে। তারা জিজ্ঞেস করল, ‘কি ভাবে?’ আমি বললাম, ক্লাসে দুই চার জন থাকে যাদেরকে এমনি চেনা যায়। যে ক্লাসে খুব ভাল আর যে ক্লাসে খুব বদ। তারা হেসে ফেলল। যাক এখন একটু সহজ হলাম।
বর্তমানে বাংলাদেশে শিক্ষার হার ৬৩% প্রায়। তবে গ্রামে শিক্ষা ব্যবস্থা খুবই খারাপ বলে আমার মনে হল। আমি প্রায় প্রতিটা ক্লাসে ইংরেজি বিষয় পড়াতাম। ক্লাসে এমন এমন কতগুলো ছাত্রছাত্রী ছিল যারা ইংরেজি পড়তে পারত না অথচ ক্লাস নাইনে পড়ে। অন্য ক্লাস গুলোতেও একই অবস্থা। খুব মন খারাপ হত। পড়াশোনা করার কোন ইচ্ছাই নেই। ক্লাসে বসে কথা বলা ছাড়া তারা কিছুই জানত না। কোন একটা দিকেও তারা ভাল ছিল কিনা জানি না। দুষ্টামিগুলো যদি ক্রিয়েটিভ হত তাহলেও আমার কোন খারাপ লাগা থাকত না।
দুমাসে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। খাঁচার ভিতর বন্দি পাখির মত চটপট করা শুরু করে দিয়েছি। তাদের কাছে জানতে পারলাম শিক্ষকরা ক্লাসে কম পড়ায় কিন্তু প্রাইভেটে বেশি পড়ায়। এমন ব্যবসার মাধ্যম যদি শিক্ষা হয় তাহলে কোথা থেকে নীতি শিখবে? আমি কিছুই ভেবে পাচ্ছিনা। সবসময় আমার শিক্ষকতাটাকে বেশি মহান এবং সম্মানিত পেশা বলে মনে হত কিন্তু এখন অবস্থা এমন যে আর শিক্ষকতা ভাল লাগে না। আমি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেছি তাই সবসময় শিক্ষকতাটাকেই বেশি পছন্দের জায়গায় রেখেছি কিন্তু এখন আমি সব ধরনের চাকরির জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমার বন্ধু আমাকে বলে, ‘সাহিত্য পড়ে ব্যাংকে চাকরির জন্য চেষ্টা করতেছিস? তোর মাথায় কি গ্যাস্টিক হইছে?’ আসলে তখন বলার কিছুই থাকে না। মুখ কালো করে বলি, তাহলে কি করব?
দুমাসে আমার এত খারাপ লাগা কেন জমা হল বুঝলাম না। আমাদের স্যাররা তো বছরের পর বছর একই কাজ করে যাচ্ছে ওনাদের তো খারাপ লাগছে না। আমি ঐ দুমাসে মনে হল অক্সিজেনহীনতায় ভুগেছি। গ্রামের মানুষগুলো ছিল লোভ লালসা মুক্ত। তারা ছিল মাটির মানুষ কিন্তু এখন তারাও দলাদলি করতে জানে। অসাধুতা শুধু শহরে নয় গ্রামের মানুষগুলোকেও আক্রমণ করে ফেলছে। মানুষ এখন আর মানুষের মত চিন্তা করতে পারছেনা। লোভী হায়নাদের মত চিন্তা করছে। রবীন্দ্রনাথের সোনার তরীতে বার বার করে কবি মহাকালের কথা উল্লেখ করেছেন। মহাকাল কবির সকল কর্মকে ধারণ করেছে কিন্তু কবিকে নয়। আমাদের জীবনেও কিছু কিছু কাজ যেগুলোই আমাদের বাঁচিয়ে রাখবে মহাকাল ধরে তা আমরা শিক্ষকদের কাছ থেকে জেনে এসেছি কিন্তু এখন তা অম্লান হয়ে গেছে। যুক্তিহীন বুদ্ধিহীন হীনমন্যতায় ভুগছি আমরা, আমাদের চারপাশের পরিবেশ।
.
৮ আগস্ট ২০১৬