আমরা থাকতাম নাখালপাড়ার লুকাসের মোড়ের কাছি এক বাড়িতে, বাড়ির নাম আলেক মঞ্জিল। আমরা দুইতলায় থাকতাম, রুমগুলো ছিলো অনেক বড় বড়। এখনকার ফ্ল্যাটের রুমগুলো দেখলে চড়ুই পাখির বাসার মতো মনে হয়।
আমরা সেই বাসায় নানারকম খেলা খেলতাম। আমাদের দুই ভাইয়ের একটা রিক্সা ছিলো। রিক্সাতে সামনে একজন বসতে পারতো পেছনে দুইজন। আমি আর আমার ছোট ভাইয়ের বয়সের ব্যবধান মাত্র এক বছরের। আমাদের পাসের বাসায় থাকতো মাঈন নামের একটি ছেলে, ওর বয়সও আমাদের মতই। মাঈন প্রায়ই আমাদের সঙ্গে খেলতে আসতো। আমি রিক্সার সামনে বসতাম পেছনে মাঈন ও ছোট ভাই। আমাদের বারান্দাটাও অনেক বড় ছিলো। বারান্দার এক মাথার নাম ফার্মগেট, আরেক মাথার নাম নাখালপাড়া। ফার্মগেট নামটা শিখেছিলাম রিক্সাওয়ালাদের কাছ থেকেই। আমরা বারান্দায় দাড়িয়ে দেখতাম রিক্সাওয়ালারা ফার্মগেট যাওয়ার জন্য যাত্রী খোঁজার জন্য ডাকছে ফার্মগেট, ফার্মগেট। সেটা দেখতে দেখতে আমাদের ঐ খেলার উৎপত্তি। আমরা ভাড়া দিতাম কাগজের টাকা দিয়ে। কি কারণে যেন একবার মাঈনের সঙ্গে একবার ঝগড়া হয়েছিলো, দুই ভাই মিলে মাঈনকে মাইর লাগাইলাম। অনেক দিন মাঈন আমাদের বাসায় আসে নাই।
মাঈনের মামা সম্ভবত আমেরিকা থাকতো, ওর মামা আমেরিকা থেকে একটা পিস্তল পাঠাইলো পিস্তলে গুলি করলে লাল-নিল বাতি জ্বলে। পাশাপাশি মিউজিক বেজে উঠে। পিস্তলটি চলতো ব্যাটারী দিয়ে। সেই পিস্তলের প্রতি আমাদের ব্যাপক আগ্রহ ছিলো। মাঈন আমাদের কম ধরতে দিতো। সেই ছোট বয়সেই মাঈন ওর পরিবারে আমেরিকা চলে যায়। ওর সঙ্গে আমাদের আর কখনো দেখা হয় নাই।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমাদের খেলার ধরনও পাল্টাতে থাকলো। আমাদের ঐ সময় কিছু নিষিদ্ধ খেলা ছিলো। যেমন, মার্বেল, লাটিম, ঘুড্ডি উড়ানো। সবাই বলতো ঐ সব খেলা খেলে খারাপ ছেলেরা। তাই আমরা ঐ সব খেলা চেষ্টা করতাম লুকিয়ে লুকিয়ে খেলতে। এলাকার বড় ভাইরা দেখলেই মার্বেল লাটিম নিয়ে যাইতো। ঘুড্ডি উড়ানোর সময় আসলেই সুতায় মাঞ্জা দেয়া, কাটাকুটি খেলা। সুমন ভাইয়ের মাঞ্জা ছিলো অসাধারণ তাঁর সঙ্গে কাটাকুটি করে কেউ পারতো না। আমরা তখন পলিথিন দিয়ে নিজেরা ঘু্িড্ড বানাতাম। সেই খেলা ছিলো অনেক আনন্দের।
আরেকটা খেলা ছিলো এলাকায় পয়সা দিয়ে ভিডিও গেম খেলাম। আমাদের কাছে মোস্তফা ছিলো অনেক প্রিয়। মোস্তফা খেলতে খেলতে এমন এক্সপার্ট হয়ে গেলাম যে এক কয়েনে গেম শেষ করে দিতে পারতাম। এরপর থেকে এলাকার দোকানদার আমাকে কয়েন দিতে চাইতো না। গেমসে সবার প্রথম পছন্দ ছিলো মোস্তফা, তারপর জ্যাক, তারপরে মেস শেষে হেনা। হেনাকে নিয়ে কেউ খেলতো না। কারণ হেনাকে নিলে বস আর চ্যালারা রেগে চায়। মোস্তফা আর জ্যাক নামে সবাই ওদের ডাকলেও মেসকে সাবই বটকু অথবা মটকু ডাকতো। আর হেনাকে ডাকতো মাইয়া। হেনাকে কেউ না নিলেও বস মারার হেনার বিজয়ের উল্লাসটা ছিলো বেশ রোমান্টিক। মোস্তফা এখনও ভালো লাগে, ছোট ভাই বাপ্পির কাছ থেকে এনে কম্পিউটারে প্রায়ই খেলি। তবে সেই আনন্দ আর পাই না।

আমরা যখন চতুর্থ/পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি। তখন আমাদের কিছু ঋতুভিত্তিক খেলা শুরু হয়ে গেলো। যেমন, লিচুর বিচি দিয়ে খেলা। সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতাম আর লিচুর বিচি টোকাইতাম। নাখালপাড়ার রাস্তায় লিচুর বিচি খুঁজে পাওয়া যেত না। তখন ঠিক করলাম আমরা দূরে দূরে লিচুর বিচি সংগ্রহ করতে যাব। রেললাইন ধরে মহাখালী রেলগেইট পর্যন্ত চলে যেতাম লিচুর বিচির সন্ধানে। কখনও কখনও তেজগাঁও স্টেশন পর্যন্ত। আমরা লিচুর বিচি দিয়ে যে খেলাটা খেলতাম সেটা ছিলো নাইক্কামুঠ। নাইক্কামুঠের মাধ্যমে শুধু লিচুর বিচি খেলতাম তা না, মার্বেলসহ আরো নানারকম খেলা খেলতাম। আমরা সেই খেলায় শুধু যে সমবয়সীরা ছিলাম তা না, বড়রাও আমাদের সঙ্গে খেলতো। রিপন ভাই, মানিক ভাই, বন্ধু রাজিব, ছোট ভাই রানাসহ আরো অনেকে খেলতাম। রিপন ভাইয়ের সংগ্রহে বড় রেডকাউয়ের কৌটা ভরা লিচুর বিচি ছিলো।
সেইদিনগুলির খেলাও নেই, খেলার সাথীরাও নেই। কই যে আছে কে জানে! এখনও যখন সময় পাই ফেসবুকে মাঝে মাঝে ঐ মানুষগুলোর নাম দিয়ে সার্চ দেই কাউকেই খুঁজে পাই না।
আচ্ছা এখন কি সেই খেলাগুলো কেউ খেলে?
১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪২১