মোবাইল নামক বস্তুটি আমাদের দেশে সহজ লভ্য হওয়ার আগে আমাদের সময় জ্ঞান খুব উন্নত ছিল। অন্তত আমার ধারণা তাই। আমরা কখন খেলতে যাব, কয়টায় এক সঙ্গে হবো সবকিছুর একটা রুটিন ছিল। সেই রুটিন আমরা অনুসরণও করতাম খুব সতর্কভাবে।
সেই অভ্যাস থেকেই সম্ভবত এই সময় নিয়ে অনেক বেশি সতর্ক ছিলাম দীর্ঘদিন। এখনও চেষ্টা করি, কিন্তু কেন জানি দিন দিন এই বিষয়ে নিচের দিকেই যাচ্ছি।
আমার মনে আছে প্রথমে যখন কাকে এসে কাজ শুরু করি তখন কাকের মানুষগুলা থেকে অনেক উৎসহ পেতাম। এখানকার মানুষগুলার সময়জ্ঞান ছিল দেখার মতো। এঁদের সঙ্গে থেকে থেকে আমার নিজেরও সময় জ্ঞান আরো উন্নত হচ্ছিল। তারপরেও আমি একটা ধাক্কা খেয়েছিলাম সময় নিয়া। সেটা ছিল শহিদুর রহমান রোমেল ভাইয়ের কাছ থেকে।
কাকে মাত্র ঢুকেছি। প্রথম দিককার ঘটনা বলা যায় এটা। রোমেল ভাই একদিন নির্দেশ দিলেন পরের দিন তাঁর বাসায় যেতে হবে। সময় দিলেন সাড়ে দশটার দিকে। বাসায় গিয়ে বেশ কিছু ডিভিডি আনতে হবে। ডিভিডিগুলা কাকের সংগ্রহে রাখতে হবে। যাওয়ার কথা ছিল সাড়ে দশটায় আমি গিয়েছিলাম এগারটায়। পুরাপুরি আধা ঘণ্টা দেরি। কেন দেরি হয়েছিল সেটা এখন আর একদমই মনে নাই। যাওয়ার পরে রোমেল ভাই ডিভিডি দিয়ে বলেছিলেন, ‘তুমি কিন্তু আধা ঘণ্টা দেরি করেছ। আমার যদি অন্য জরুরি কাজ থাকতো তাহলে কি হতো বলো তো?’
কাকের মানুষগুলার কথাবার্তা ছিলই সব সময় এই রকম। কখনই কঠিনভাবে কথাবার্তা বলেন না। কিছুটা যুক্তি দিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করেন তোমার এই কাজটা ঠিক হয় নাই। এমন সব কঠিন যুক্তি দিবে যে যুক্তি খণ্ডন করা কঠিন। অন্তত আমার পক্ষে অনেক কঠিন। যেমন রোমেল ভাই অনেকদিন পরে আবার কি একটা কাজ দিয়েছেন। এটা ছিল দ্বিতীয় কাজ, সঙ্গে সঙ্গে বলে দিয়েছেন দেরি যেন না হয়। আমি উত্তরে বলেছিলাম, ‘ভাইয়া আমি তো দেরি করি না।’ রোমেল ভাই সেই পুরানা দিনের কথা তুলে এনেছিলেন, ঐদিন কিন্তু তুমি দেরি করে আসছিলা। আমার উত্তর ছিল, ‘ভাইয়া ঐটা তো একদিন হয়েছিল।’
তখন রোমেল ভাই যুক্তি দিয়ে বুঝালেন। ‘দেখ শরীফ ঐটা ছিল তোমার সঙ্গে আমার প্রথম কাজ। প্রথম কাজেই তুমি দেরি করে আসছিলা, তোমাকে বিচার করার সুযোগ আমি মাত্র একবার পেয়েছি।’ এর পরে আমার আর উত্তর দেয়ার কিছু ছিল না। আসলেই আমাকে বিচার করার মাত্র একটা দিনই তিনি পেয়েছিলেন। তবে আমি শেষ পর্যন্ত সম্ভবত সেই দুর্নাম দূর করতে পেরেছিলাম। ঐ ঘটনার পর থেকে আমি আরো সতর্ক হয়ে গিয়েছিলাম।
আরেকটা মানুষের কাছে আমি প্রচুর উৎসাহ পেতাম। সে হল রাসেল ভাই। তিনি দীর্ঘদিন মোবাইল ব্যবহার করেন নাই। সম্ভবত পুরা অনার্সেই তিনি মোবাইল ব্যবহার করেন নাই। কাকের প্রতিটা মানুষেরই এমন আলাদা আলাদা একটা স্বকীয়তা ছিল। মোবাইল ব্যবহার না করেও রাসেল ভাইকে পেতে কোনদিন কোন সমস্যা হয় নাই। বাসায় থাকলে টিএনটিতে ফোন দিলে পাওয়া যেত। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকলে তাঁর বন্ধুদেরকে ফোন দিলে পাওয়া যেত। আর কাকে থাকলে তো বন্ধুরা টিএনটিতে ফোন দিয়ে পেত। অথবা আমাকে ফোন দিলেও পেয়ে যেত।
রাসেল ভাই কোথায় কখন থাকে এমন একটা ধারণা করে কাউকে ফোন দিলেই পাওয়া যেত। এমনকি দেখা গেছে কোন একটা জরুরি কাজে আমার সেঙ্গ দেখা করতে হবে জায়গা আর সময় বলে দিতেন। ঠিক সেই সময়ে ঐ জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতেন। হয়তো পাঁচদশ মিনিট আগেই দাঁড়িয়ে থাকতেন।
আমার পক্ষে প্রায়ই সময় নিয়ে ঝামেলা হতো। বিশেষ করে ঢাকা শহরের জ্যামের কারণে। সাইকেল ব্যবহার শুরুর পরে সেই বিড়ম্বনা থেকে আমি একদম মুক্তি পেয়েগিয়েছিলাম। আর যাই হোক অন্তত সময় নিয়ে আমাকে কেউ কোনদিন কথা বলতে পারতো না। এমনকি যে কোন কাজ সময়মতো শেষ করে ফেলাটাও ছিল অভ্যাসের মতো।
তবে এখন আর আগের মতো হয়ে ওঠে না। প্রায়ই ভুল হচ্ছে। এমনকি লক্ষ্য করলাম যেই মানুষগুলার কাছ থেকে উৎসাহ পেতাম তাঁরাও এখন আর কথা দিয়ে কথা রাখতে পারছেন না। তাঁদের সঙ্গে সঙ্গে আমি নিজেও পারছি না…
৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৫
