সালমান শাহর মৃত্যুর সঙ্গে আরেকটি প্রেমেরও মৃত্যু

Salman Shah
সালমান শাহ, ছবি: ইন্টারনেট

আমি এখন যে সময়ের কথা বলতেছি সেটা ১৯৯৫/১৯৯৬ সালের ঘটনা। আমরা যে বাড়িটাতে ভাড়া থাকতাম সে বাড়ি রুম সংখ্যা ছিল সাতটার মতো। সব রুমই আলাদা আলাদা করে ভাড়া দেয়া। বাড়িওয়ালা দুই ভাইয়ের ঘর ধরলে রুমের সংখ্যা আরো বেশি হবে। পুরো বাড়িতে টিভি ছিল মাত্র দুইটা। তাইও সাদাকালো। একটা আমাদের আরেকটা বাড়িওয়ালার। রাত আটটার বাংলা সংবাদের পর ঘরে যায়গা থাকত না। টিভিতে নানা রকম প্রোগ্রাম দেখাইত। মানও ছিল অসাধারণ, নাটক দেখে কতজনের চোখের পানি আর হাসি দেখেছি। তা হিশাবের বাইরে।

বাড়ির বড় ভাই/বোনেরা মিলে এক/দুইমাস পর পর ভাড়া করে ভিসিআর/রঙ্গিন টিভি আনার ব্যবস্থা করত। তখন তিনটা ক্যাসেট সহ ভিসিআর আনতে ১৮০ টাকার মত লাগত। টিভির জন্য আরো ৫০ টাকা। সবার চাঁদা দেয়া লাগলেও আমাদের ছোটদের কোন চাঁদা দেয়া লাগত না। আমরা সারা রাত বসে বসে আনন্দের সঙ্গে মুভি দেখতাম। তখনকার সময় সবচাইতে সুপার হিট ছিল সালমান শাহ্ আর সাবনুরের জুটি। ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’, ‘অন্তরে অন্তরে’, ‘তোমাকে চাই’, ‘বিক্ষোভ’, ‘বিচার হবে’, ‘চাওয়া থেকে পাওয়া’, ‘স্বপ্নের পৃথিবী’, ‘সত্যের মৃত্যু নেই’ আরো কত যে ছবি দেখেছি তার হিশাব নেই।

আমাদের ছবি দেখানোর এবং সবকিছু ম্যানেজ করতো সুমন ভাই। সুমন ভাই ছিল দুই বাড়িওয়ালার বড় জনের ছেলে। এই লোকটি ছিল এক আশ্চর্য প্রেমিক, বিয়ে করছিল ১৪ এর উপরে (তার গল্প আরেকদিন লিখব)। তো সুমন ভাই সব কিছু ম্যানেজ করতো এবং একটা ঘরও খালি করার ব্যবস্থা করত। আমরা সারা রাত ছবি দেখতাম। দিনের বেলা ঘুমাইতাম, আর পরবর্তী ছবি দেখার দিবস না আসা পর্যন্ত ছবিতে দেখা গানগুলো সবার মুখে মুখে থাকত। আর রেডিওতে সিনেমার গান তো শুনতামই।

একদিন সবাই ক্রিকেট খেলতেছি, হঠাৎ চোখে পড়ল সুমন ভাইয়ের হাতে লেখা R+S। আমরা অনেক গবেষনা করে বের করলাম “আর” দিয়ে একমাত্র রিনা আপার নামই হতে পারে। রিনা আপা আমাদের ঐ বাড়িতেই থাকতেন। ঐ বয়সে আমার দেখা সবচাইতে সুন্দর মেয়ে, বয়স ১৭/১৮ হবে। একসময় আমাদের কাছে মোটামুটি পরিষ্কার হয়ে গেল, সুমন ভাই রিনা আপাকে পছন্দ করেন। কিন্তু রিনা আপা তেমন পাত্তা দেন না। তবে আমার মনে হত রিনা আপাও সুমন ভাইকে পছন্দ করতেন। সুমন ভাই ছিল পুরা পাগলা প্রেমিক টাইপের। নিজের রক্ত দিয়া চিঠি লেখার পর সেটা রিনা আপাকে পাঠাইতো।

সুমন ভাইয়ের আরো কিছু পাগলামি ছিল। যেমন তিনি খুব ভাল ঘুড়ি উড়াইতেন। তাঁর সঙ্গে কাটাকুটি করে কেউ পারতেন না। উনি প্রেমে পড়ার পর প্রতিদিন দুইটা তিনটা ঘুড্ডি কাটাকুটিতে ইচ্ছা করে হারতেন। সেই ঘুড্ডিগুলাতে রিনা আপার নাম লেখা থাকত। কিন্তু তাঁর প্রেম বেশিদিন টিকল না। সুমন ভাই একদিন তাঁর বাবার কাছে ধরা খাইয়া গেলেন। মোটামুটি পুরা পাড়া জানাজানি হইয়া গেল। সুমন ভাইকে ঘরের মধ্যে ঢুকাইয়া ইচ্ছা মতো মাইর খাইল। শুধু মাইর দিয়াই ক্ষ্যান্ত হইল না, কোরান শরীফে হাত দিয়া প্রতিজ্ঞা করতে হইলে এই মেয়েকে তার ভুলে যেতে হবে।

এই ঘটনার পরে সুমন ভাই প্রায়ই একা একা পাশের বাসার ছাদে বসে থাকতেন। চুপচাপ থাকতেন, ঘুড়ি উড়াতেন না। আমি ছাদে গেলে আমাকে একটা গল্প শোনাতেন। ‘একটা ছেলে একটা মেয়ে অনেক ভালবাসত, মেয়েটাও ছেলাটাকে ভাল বাসত।‘ মাঝে মাঝে হাউমাউ করে কেঁদে উঠতেন।

অল্প কয়েকদিন পরেই সালমান শাহ্রর মৃত্যুর খবর। এই খবরে সুমন ভাই আরো বেশি মনমরা হয়ে গেলেন। আরো কয়েকমাস পরে রিনা আপাও চলে গেলেন।

আমার এই জীবনে অনেক প্রেম দেখেছি। সুমন ভাই আর রিনা আপার প্রেমের মত এত গভিরতা আর কোথাও দেখি নাই।

আজ সালমান শাহর মৃত্যু দিবস।

৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪।

Comments

comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.