খুব সকালবেলা বড় ভাইয়ের সঙ্গে বের হয়েছি। টেম্পুতে ফার্মগেট, তারপর ফার্মগেট থেকে বাসে মিরপুর সাড়ে এগার। সাড়ে এগার থেকে বার নাম্বারের দিকে সামান্য হাঁটার পরে একটা গার্মেন্টস। সেটাই আমাদের গন্তব্য, এখন আর সেই গার্মেন্টসের নাম মনে নাই। কাজ শুরু হয় আটটার দিকে। অনেকে পনের বিশ মিনিট আগে আসলেও কাজ শুরু করে আটটায়। ঠিক আটটায় একটা শব্দ হয় বা ঘণ্টা বাজে। এই ঘণ্টাটা স্কুলের ঘণ্টার মত না। অনেকটা হোটেলে খাওয়ার পরে বিল দিতে গেলে ম্যানেজার বিল নেয়ার জন্য ম্যাসিয়ারের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য যে বেল চাপে অনেকটা সে রকম।
সাইরেন দেয়ার পর পরই সবাই কাজ শুরু করতো। সবাই সেলাইয়ের কাজের পরে বিশাল একটা টেবিলে কাপড় এনে রাখতো। বেশির ভাগই ছিল টি-শার্ট। আমার কাজ ছিল সেইসব কাপড়ের বাড়তি সুতা কাটা এবং কাপড় ভাজ করে রাখা। সুতা কাটতাম ছোট একটা কাটার দিয়া, সুতা কাটতে খুব ভাল লাগতো। বিশেষ করে সুতা কাটার সময় একটা শব্দ হত, শব্দটা নেশার মতো লাগতো। সেই সুতা কাটার শব্দ এখনো মিস করি। এখন অবশ্য কম্পিউটারের কি-বোর্ডের শব্দও খুব ভাল লাগে।
দুপুর ঠিক একটা বাজার সঙ্গে সঙ্গেও একটা সাইরেন দিত। সেই সাইরেনের সঙ্গে সঙ্গে সবাই কাজ বন্ধ করে দিত। মেশিন থেকে উঠে যেত। অনেকটা জরুরি অবস্থার মত এখনি বের হতে হবে এমন একটা অবস্থা। আমি সব সময় হাতের কাজটা শেষ করে তারপর উঠতাম। এটা নিয়ে দেখতাম দুয়েকজন আপু হাসাহাসিও করতো। আরেকটা বিষয় ছিল তখন আমি ছোট ছিলাম, বন্ধুরা যেখানে স্কুলে পড়ালেখা করে আমি সেখানে কাজ করতেছি। আমার তখনও অনেক কিছু বুঝার বাকি। অতিরিক্ত কাজের জন্য তো আর টাকা দিবে না, তাই শুধু শুধু কাজ করার কোন কারণও কেউ বোধ করে না।
পূর্বের দিনের শ্রমিকেরা নাকি সব সময় কাজে মন দিত। এই রকমই একটা লেখা পড়েছিলাম ফ্রানৎ ফাঁনো নামের একজন লেখকের সম্পর্কে। যা সলিমুল্লাহ স্যারই লিখেছিলেন কোথায় যেন। তাঁর ‘আদম বোমা’ অথবা ‘স্বাধীনতা ব্যবসায়’ বইয়ে হবে হয়তো। বর্তমান শ্রমিকেরা এখন আর খুব একটা কাজে মন দেয় না, মন দেয় মনিবে। কাজের চাইতে মনিবকে তেল দেয়াকেই বেশি প্রাধান্য দেয়। এখানেও দেখা যায় একটু উল্টা হয়ে গেছে বিষয়গুলা। স্যারের সঙ্গে থাকার কারণে প্রায়ই শব্দের যোগাযোগ বা ভাষার ব্যবহারের ব্যাখ্যা পাই আর চমৎকৃত হই। যেমন তেল হইল একটা স্নেহ জাতীয় পদার্থ। আমরা কথায় কথায় বলি ছোটদের ভালবাসা দিতে, স্নেহ করতে হবে। সেই স্নেহই হইল তেল দেয়া। কিন্তু এখন তেলটা ব্যবহার হয় একটু নেতিবাচক হিসাবে। মানে বড়দের স্নেহ দেয়া মানে হইল তেল দেয়া। আসলে বড়দের ভালবাসার সঙ্গে শ্রদ্ধা করা উচিত, আমরা তাই শিখে এসেছি, বড়দের স্নেহ দিতে কিছু মনে হয় ছিল না। বর্তমানে শ্রমিকের উন্নতি হয় মনিবকে তেল দিলে, কাজে মন দিলে এখন আর শ্রমিকের উন্নতির পথ কঠিন। প্রমোশন থেকে শুরু করে মনিবের নেক নজর বুঝি এই তেল দেয়াতেই নিহিত আছে।
দুপুরে সাইরেন দেয়ার পরে যাঁদের বাসা কাছে তাঁরা খেতে চলে যেত। আমাদের অনেকের বাসা দূরের ছিল বলে খাবার বাসা থেকেই নিয়ে আসতে হত। সেই খাবার খেতাম। আম্মা রুটি বানিয়ে দিতেন, সঙ্গে থাকতো আলু ভাজি অথবা কোন একটা সবজি, মাঝে মাঝে ডিমও থাকতো। খাওয়া-দাওয়ার পরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম, তারপর দুইটার সাইরেন বাজলে আবার কাজ শুরু। এর পরে সন্ধ্যার সাইরেনের শব্দ না হওয়া পর্যন্ত কাজ।
আমার মনে আছে প্রথমদিন টয়লেটে গিয়েছিলাম মোট চারবার। প্রথম দুইবার হিসু-মুতু করার জন্য তৃতীয়বার হাগু করার জন্য। চতুর্থবার আবার হিসু-মুতু করতে গিয়েছিলাম। তখন হিসু করে বের হয়ে দেখি, দুইটা আপু দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে সঙ্গে সঙ্গে দুইজনের একজন একটা কাগজ বুকের মধ্যে লুকিয়ে ফেললো। এখন বুঝতে পারি সেই কাগজে নিশ্চয় কোন প্রেমের কথা লেখা ছিল। তাঁরা আমাকে ঝাড়ি দিয়া বলল, ‘তুমি মেয়েদের টয়লেটে আসছো কেন? ছেলেদের টয়লেটে যাও।’
পৃথিবীতে নতুন একটা জিনিশ শিখলাম। ছেলেদের টয়লেট আর মেয়েদের টয়লেট আলাদা হয়। আমাদের স্কুলে ছেলে আর মেয়েদের শিফট ছিল আলাদা। মেয়েরা সকালে আর ছেলেরা সাড়ে এগারটার পরে ক্লাশ করতাম। একমাত্র পরিক্ষার সময় এক সঙ্গে পরিক্ষা হত, সেটাও দেখা গেছে মেয়েদের তিনতলায় আর ছেলেদের নিচতলায়। দ্বিতীয় তলায় কিছু অংশ ছেলে আর কিছু অংশ মেয়ে। তখন অবশ্য দ্বিতীয় তলায় মেয়েরা টয়লেট ব্যবহার করতো আর ছেলেরা নিচ তলায়। কিন্তু সেটা যে ছেলেমেদের জন্য আলাদা বুঝতে পারিনি।
আমাদের কাজ শেষ হতো সাধারণত সাতটা অথবা আটটা। কাজ শেষে সবাই বাসার পথ ধরতাম। বাসায় ফিরে এত ক্লান্ত লাগতো যা বলার মত না। কোন রকমে খেয়েই ঘুম। সেই ঘুমটাও হত একদম অন্যরকম। একঘুমে সকাল। ক্লান্ত না লাগার কোন কারণও নাই, ১২ ঘণ্টা কাজ ২ ঘণ্টার জার্নির পরে ঘুম না হওয়াটাই বরং অভিশাপ…
১৩ ফাল্গুন ১৪২৪
ছবি: মূর্শেদূল কাইয়ুম মেরাজ
