সুসং দূর্গাপুর ভ্রমণবৃতান্ত (১)–মূর্শেদূল কাইয়ুম মেরাজ

12182846_971987909506257_8918708456526683114_o


(বৈষম্য)

মহাখালি থেকে রাত একটায় বাস ছেড়েছে…
পূঁজার ছুটিতে যাচ্ছি সুসং দূর্গাপুর…
বাসের সকল সিটই যাত্রীদের দখলে…
দাঁড় করিয়ে লোক নিবেনা বলেছে তাহলে এখনো লোক উঠছে কেনো…
প্রশ্ন আমাদের…
এবারো আমরা যথারীতি দু’জন শরীফ আর আমি…
অবশ্য অনেকেরই যাওয়া কথা ছিল… শেষ পর্যন্ত দুজনই যাচ্ছি…

সে কথা থাক… আমাদের পাশাপাশি সিটে বিশালদেহী দুই সুন্দরী নারী বসেছে… তারা আভিজাত্যে যেনো এই বাসে মানিয়ে নিতে পারছে না… সামনে পেছনের সীটেও সম্ভবত তাদের আত্মীয়-স্বজনরা রয়েছে… তাদের ঠিক পেছনের সীটের ভদ্রলোক আমাদের দুজনের দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছিলো যে মন্ত্রবলে আমাদের ছাই করতে পারছেনা বলে আপসোস করছে… বিষয়টা বেশ মজার লাগলো… গুড… ভেরি গুড… ভদ্রলোকের অভিশাপ নিতে নিতেই ব্যাগ পত্র ঘুছিয়ে বসলাম… তবে এ বাসে আরাম করে বসার উপায় নেই… পিঠ খাঁড়া করে বসে থাকতে হবে… পা রাখার জায়গাও পর্যাপ্ত না… কিন্তু সেগুলো বড় সমস্যা না… বাস সময় মতোই ছেড়ে দিলো… তবে যাত্রী উঠা কিন্তু থামছে না…

কিছু সময় পর সীটের নিচ থেকে প্লাস্টিকের মোড়ে বের হতে লাগলো… যাত্রীদের বাসের মাঝে যাতায়াতের রাস্তার উপর মোড়া দিয়ে বসিয়ে দিলে লাগলো সুপারভাইজার… সুপাইভাইজারের ব্যবহার দেখে মনে হচ্ছিল যারা মোড়ায় বসে যাচ্ছে তারা মানুষই না… যখন খুশি তদের পেছনে পাঠাচ্ছে… দাঁড় করাচ্ছে… সামনে আনছে… সীটে বসা যাত্রীরাও তাদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতে ভুলছে না… এই সরো সরো… সরে বসো… এসব কথা এমনভাবে বলছে যেনো তাদের স্পর্শে ধর্মনাশ হয়ে যাবে… প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় আমরা শিক্ষিত হচ্ছি বটে… কিন্তু মানুষ হচ্ছি কি??? যাত্রীদের আচরণ দেখে প্রশ্নটা ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠলো…

টাকা হলে কেতাদুরস্থ পোষাক কেনা যায়… খোলশ কেনা যায়… কিন্তু মানুষ বেশিক্ষণ তা দিয়ে তার আচরণ কি ঢেকে রাখতে পারে??? যাক সে কথাও বাদ দেই… এক জায়গায় ঘুঁড়তে যাচ্ছি মন মেজাজ খারাপ করার মানে হয় না… মোড়ায় বসা যাত্রীরা হেডফোন কানে গুজে দিয়ে ততক্ষণে ঝিমুতে শুরু করেছে… যারা ঢাকার ১৩ নাম্বার বাসে যাতায়াত করেছেন তারা জানেন শামুকের গতিতে কিভাবে বাস চলতে পারে… এই বিরিশির বাস মনে হচ্ছে তাকেও হার মানাবে বলে প্রতিজ্ঞা করেছে… আর এই অপমান সইতা না পেরেই হয়তো ১৩ বাস বন্ধ হয়ে গেছে ঢাকার পথ থেকে…

সুসং দূর্গাপুর যেতে সর্বোচ্চ নাকি ঘণ্টা তিনের লাগে… সেটাকে টেনে ৫ ঘণ্টা করবে ড্রাইভার… নইলে মধ্যরাতে যাত্রা শেষ করলে যাত্রীরা কোথায় যাবে… সবই বুঝলাম কিন্তু এমন গতির গাড়িতে বসে থাকা যে কি বিরক্তির তা বলে বোঝানো মুশকিল… আমাদের জ্ঞানগর্ভ আলোচনা ঘণ্টাখানেক চলে থেমে গেছে… রাত গভীর হচ্ছে… নিরবতা বাড়ছে… ময়মনসিংহ রোড চার লেন হয়েছে… নতুন রাস্তায় বেশ আরামেই চলেছি আমরা…

ঢাকা থেকে অনেক চেষ্টা করেও বিরিশিতে কোনো রেস্ট হাউজে থাকার ব্যবস্থা করতে পারিনি… সবই নাকি বুক হয়ে আছে… সকালে যেয়ে রুম খুঁজতে হবে আগে… তবে তা নিয়ে আমরা বিশেষ চিন্তিত তা নয়… একটা ব্যবস্থা হবেই… না হলে গাছ তলায় থাকবো… সেটা বড় সমস্যা নয়… খুঁতখুঁতে বা কমপ্ল্যান বয়রা সাথে থাকলে ভিন্ন কথা… তখন মহা মুশকিলে পরতে হয় এমন পরিস্থিতিতে… ভ্রমণে তারা নিজেরাও স্বস্তিতে থাকে না… অন্যদেরও থাকতে দেয় না… সব কিছুতেই তাদের অভিযোগ থাকে…

একসময় চকচকে রাস্তা ফুঁরিয়ে এলো… বাসে ঢেউ জেগে উঠলো… বাসের যাত্রীরা উঠে বসলো… সীট চেপে ধরলো অনেকে… রাস্তার অবস্থা চরম খারাপ… মনে হচ্ছে বাস উল্টে যাবে… এবার বাসের গতি এতোটাই কমে গেলো যে তার সাথে আর শামুকের তুলনাও করা যাচ্ছে না… ভোর হবে কিছু পরে… আমরাও হয়তো কিছুসময় পরেই পৌঁছে যাবো গন্তব্যে… ঠিক বললাম কি??? মানুষকি তার গন্তব্যে আদৌ কখনো পৌঁছাতে পারে!!!

.


(খোঁজাখুঁজি)

বাস থেকে যখন নেমেছি তখনো ভোরের আলোয় বিরিশিরি আলোকিত হয়নি…
আমাদের আগেই বহু পোলাপান ব্যাগ পত্র নিয়ে রাস্তার এখানে সেখানে অপেক্ষা করছে… সম্ভবত হোটেল খোলার অপেক্ষা করছে… শরীফ বললো ভাই চলেন আগে নৃতত্ত্বের বাংলোটার খোঁজ নিয়া আসি… যে পরিমাণ মানুষ আসছে তাতে হোটেল পাওয়া মুশকিলে পরতে হবে… এতোক্ষণে এটা স্পষ্ট যে রাস্তায় যারা অপেক্ষা করছে তাদের হোটেল বুকিং নেই… অর্থাৎ আমাদের মতোই অবস্থা… এবং পেছনে বাসের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে… তারমানে আরো মানুষ আসছে… আর দেরি করা চলে না… আমরা হাঁটতে শুরু করলাম…

11251858_973310612707320_4027170989795036133_oবিরিশিরিতে থাকার সবচেয়ে জনপ্রিয় স্থান হচ্ছে ywca ও ywmc রেস্টহাউস এবং নৃতত্ত্বের বাংলো… পূঁজার লম্বা ছুটির কারণে এগুলো আগে থেকেই সব বুক হয়ে আছে… নৃতত্ত্বের বাংলোটা সরকারি… শরীফ বললো সেটা ভেরতে নাকি বেশ বড় জায়গা পাওয়ার সম্ভবনা আছে… তবে সেখানে যেয়ে যা বুঝলাম তারা ভাড়া দিতে বিশেষ আগ্রহী নয়… তাই সঠিক ভাবে জানাও গেলো না আসলে খালি আছে নাকি অতিথিতে পূর্ণ… গুটি গুটি পায়ে যখন সেখান থেকে বের হয়ে আসছি তখন দেখলাম মোটামুটি আলো ফুটেছে… অপেক্ষমান প্রায় সকলেই আশ্রয়ের খোঁজে ব্যাগপত্র নিয়ে বেড়িয়ে পরেছে… বিরিশিরি মতো ছোট্ট জায়গায় অতিথির তুলনায় থাকার জায়গা অপ্রতুল হবে সেটা স্বাভাবিক… রাস্তার পাশে অবশ্য আরো দুটি হোটেল আছে… একটি স্বর্ণা রেস্ট হাউজ ও অন্যটি নদী বাংলা… এ দুটোর সামনেও ব্যাগ-পত্র নিয়ে ছেলেপেলেরা ভিড় করে আছে… দরজা খোলার অপেক্ষায়… এখানেও আশ্রয় পাওয়ার সম্ভবনা নেই বললেই চলে… একটু পরে স্বর্ণা হোটের দোতলার উন্মুক্ত ছাদে এক মহিলাকে দেখা গেলো… শরীফ বললো ভাই চলেন স্বর্ণা আন্টি জিজ্ঞেষ করি যদি রুম পাওয়া যায়… তবে কিছু সময়ের মধ্যে আমরা নিশ্চিত হলাম উনি স্বর্ণা আন্টি নয় উনিও বোর্ডার… কিছুটা হাঁটার পর গির্জার একটি রেস্ট হাউজ পেলাম… সেটি নতুন হয়েছে… তবে সেখানেও সব রুমই অগ্রীম ভাড়া হয়ে আছে…

ভেতরে প্রবেশ করতেই ভদ্রমহিলা তা জানালেন… তবে এক ফাকে জেনে নিলাম আগামীকাল সকলে একটা রুম ফাঁকা হবে… তার ফোন নাম্বার নিয়ে রাতে বুক দিবো এমন কথা বলে আবার নামলাম পথে… আপাতত একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম… রুম না পেলে কোথাও হ্যামক ঝুলিয়ে রাতটা পার করে দেবো… রাতে রুম বুক দিয়ে এই রেস্ট হাউজে ব্যাগ পত্র রেখে দেবো… আর সারাদিন চলবে ঘুড়াঘুড়ি… তখনো জানি না আমরা দিনটা কেমন কাটবে… চরম উৎকণ্ঠায় নাকি শান্তিতে!!!

.


(হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি)

কথায় আছে “যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশ”…
তাই হাল তো ছেড়ে দেয়া যায় না…
তার উপর ওস্তাদ বলছেন…
“হাল ছেড়ো না বন্ধু, বরং কণ্ঠ ছাড়ো জোরে”
কণ্ঠ ছাড়ার ক্ষমতা তো নাই… তাই আপাতত পা…ই চালাই…

থাকার হোটেলগুলো এখনো খুলতে শুরু করেনি…
তবে সেখানে যে আশ্রয় জুটবে না তা এতোক্ষণে আমরা বেশ ভালোভাবে জেনে গেছি…
অন্যদিকে খাবার হোটেলগুলো খুলতে শুরু করলেও এখনো তাওয়া গরম হয়নি…
শুরু হয়নি রুটি-পরটা ভাজাভুজি…

তাই হেঁটে হেঁটে আশেপাশে অন্য কোথাও থাকার ব্যবস্থা করা যায় কিনা সেটাই খুঁজছি… দু-একটি রিকশাওয়ালা জানতে চাইলো ঘুঁড়তে যাবো কিনা… তবে সবাইকে ছাড়িয়ে একজন রিকশাওয়ালা আমাদের পিছু নিয়ে নিলো…

সে নাছরবান্দা… আমাদের ছাড়ছে না… আমরা কোথায় থাকবো সেটা নিয়ে সে খুব ভাবনাচিন্তা করছে… তার কাছ থেকেই জানতে পারলাম দূর্গাপুর যেয়েও বিশেষ সুবিধা হবে না… সেখানের সরকারি বাংলো অগ্রিম বুকিং হয়ে আছে… আর যে হোটেল আছে সেখানেও রুম পাওয়ার কোনো সম্ভবনা নেই… আর বিরিশিরিতেতো কোনো সম্ভবনাই নেই… তবে সামনেই একটা গাড়োদের গির্জা আছে সেটার রেস্ট হাউজে খোঁজ নেয়া যেতে পারে…

আমরা সেই রেস্টহাউজের দিকেই হাঁটতে লাগলাম… সেই রিকশাওয়ালাও আমাদের পিছু পিছু আসতে লাগলো… পূর্ব অভিজ্ঞতা বলে এ ধরনের রিকশাওয়ালারা সব সময়ই টুরিস্টদের বিপদে ফেলে… তাই তাকে খুব একটা পাত্তা দিলাম না… আমরা শহুরে মানুষ… হুট করে সবাইকে অবিশ্বাস করে ফেলি… আসলে একে পুরোপুরি আমাদের দোষও দেয়া ঠিক হবে না… লক্ষ-কোটি ভন্ড-প্রতারক-ঘুষখোর-দুর্নীতিবাজরা আমাদের চারপাশে চেপে বসে থাকে… এর ভেতর থেকে আমরা সুস্থ্য মানুষিকতা নিয়ে কিভাবে বেরে উঠবো… কি সব ভাবছি এগুলো… রুম না পেয়ে কি মাথা নষ্ট হতে শুরু করলো নাকি??? বাদ দেই… তারচেয়ে হোটেল খোঁজায় মনোযোগী হই…

সেই গির্জায় যেয়ে জানলাম তাদের একটা কনফারেন্সের জন্য পুরো রেস্ট হাউজটাই বুক হয়ে আছে আগামী ৩ দিনের জন্য তখন আমাদের হাতে আর কোনো অপসন রইলো না… হঠাৎ..ই দিনের আলো যেনো নিভে গেলো আমাদের চোখে… অন্ধকার নেমে এলো ধারিত্রীতে… এখন উপায়… ভাবছি মনে মনে আমি শরীফ দু’জনেই…

একটু ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণ গড়াগড়ি করাটা দরকার ছিল… শরীরও তাই চাইছে… সারারাত ঘুমাইনি একটুও… রুম না পেলে কি এখনি ঘুঁড়তে বের হয়ে যাবো!!! এমন ভাবনা ভাবতে ভাবতেই মাথার ভেতর জীবনানন্দ ঠক ঠক করে চুপি চুপি পাঠ করতে লাগলো –

“হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল-সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয়-সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার-অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরও দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু-দন্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন ।”

12182993_973310606040654_5131699180434463936_oআমরা দাঁড়িয়ে আছি বিরিশিরির ভাঙাচূড়া রাস্তার উপর… না এটা নাটর… না বনলতা দাঁড়িয়ে আছে সামনে… আমাদের সামনে এখন রিকশাওয়ালা বাবলু ও তার রিকশা ছাড়া কিছুই নেই… আর যাই হোক তাকে তো আর বনলতা সেন কল্পনা করা যায় না… তবে এইটুকু রাস্তা হাঁটতে হাঁটতে রিকশাওয়ালা বাবলু ভাইকে বলে দিয়েছি আর কোথাও থাকার জায়গা না পেলে আমরা তার বাড়িতেই উঠছি… সেও বলেছে যদি সে ব্যবস্থা না করতে পারে তবে তার বাড়তেই নিয়ে যাবে… কিভাবে একজন রিকশাওয়ালা বাবলু আমাদের সবচেয়ে উপকারী বন্ধু হয়ে উঠলো এই চিনামাটির দেশে সে গল্প পরে বলছি…

অনেক নিষ্ঠুরতা-নির্মমতা-বর্বরতা দেশের প্রতিদিনের পত্রিকার শিরোনাম হলেও… এখনো যে এটা সোনার দেশ… এদেশের মানুষ যে সোনার মানুষ তা এদেশের গ্রামে-গঞ্জে না গেলে… তাদের সাথে না মিশলে বোঝা যাবে না কোনোদিন… টেবিল চেয়ারে বসে গবেষণা করলে অনেক কিছুই বলা যায়… করা যায়… লেখা যায়… কিন্তু বাস্তবতা বাস্তবেই বাস করে… সেটা গুগলে খুঁজে পাওয়া যায় নারে সখি… তোরে কেমনে বোঝাই…

“আমি মরিয়া হইবো শ্রীনন্দের নন্দন
তোমাকে বানাবো আধা
বনমালী তুমি পরজনমে হইও রাধা ।।

তুমি আমারই মতন কান্দিয়া কান্দিও
কৃষ্ণ কৃষ্ণ নাম বদনে বলিও ।।
যাইও যমুনার ঐ ঘাটে যাইও
আমার রঙ্গটি ছিল কত সাদা
বনমালী তুমি পরজনমে হইও রাধা ।।

তুমি আমারই মতন জ্বলিও জ্বলিও
বিরহ কুসুম হার গলেতে পরিও ।।
ঐ প্রেম না করিয়া
ছিলেম তো ভাল
আমার মনটি ছিল কত সাদা
বনমালী তুমি পরজনমে হইও রাধা ।।

ভাবিয়া সরোজ কয়
ঐ কৃষ্ণ ফদ
প্রেমেরও মায়া ডরে বান্ধিও বান্ধিও ।।

তুমি বুঝবে তখন ।।
নারীর কি বেদন
রাধার প্রাণে ছিল কত ব্যথা
বনমালী তুমি পরজনমে হইও রাধা ।”

12188908_971151536256561_7735866581683232553_n

সকল ছবি: লেখক

Comments

comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.