হিশাব করে দেখলাম এ পর্যন্ত আমি মাত্র তিনটা সেলুনে যাওয়া আশা হয়েছে। তিনটার কোনটারই নাম মনে নাই। ছোটবেলায় চেয়ারের উপরে কাঠের উপর বসিয়ে চুল কাটানো হতো। তখন মনে হতো কবে যে চেয়ারে বসতে পারবো? যেদিন চেয়ারে বসতে পারবো সেদিন থেকেই বুঝতে পারবো আমি বড় হয়ে গিয়েছি।
একটু বড় হওয়ার পরে যখন চেয়ারে বসে চুল কাটানো শুরু হলো তখন আবিষ্কার করলাম যে দোকানে চুল কাটাই সেই দোকান ছাড়াও আরেকটা জায়গায় চুল কাটালে কিছু টাকা বাঁচানো যাবে। নাখাল পাড়া স্কুলের সামনে রেললাইনের পাশে একজন বয়স্ক লোক চুল কাটাতেন। খোলা জায়গায় একটা চেয়ার, আর দেয়ালে ঝুলানো একটা আয়না। সেখানে সবসময় নিম্ন আয়ের লোকজনেরা চুল কাটাতো। আমার কাছে নিম্ন আয় বেশি আয় বড় বিষয় না। টাকা কম সেটাই বড়। এখানে চুল কাটালে কিছু টাকা পকেটে ঢুকানো যায় এটাই বড়। কিন্তু কিছুদিন পরে আবিষ্কার করলাম এটা নিযে বন্ধুরা একটু হাসাহাসি করে। বাধ্য হয়ে সেই দোকান ছাড়তে হলো।
ফিরে আসলাম আমার পুরানো দোকানে। আমি সব সময় যে দোকানে যার হাতে চুল কাটাতাম তার নাম ছিল পরিমল। পরিমাল দা সব সময় সার্ট ইন করে দোকানে আসতেন। তার এক ছেলে এক মেয়ে আমাদের স্কুলেই পড়তেন। আরেকটা ছোট মেয়ে ছিল যে স্কুলে ঢুকে নাই। ছেলেটি ছিল আমার চাইতে বছর দুয়েকের বড় বা আরো বড়। আর মেয়েটি আমার চাইতে একটু ছোট হবে। তখনকার দিনে আসলে আমরা সবাই সবার খোঁজ খবর রাখতাম। এখনকার মতো পাশের ফ্লাটে কে থাকে আমরা হয়তো চিনিও না এমন ছিল না বিষয়গুলা। আর পরিমল দার দোকানে শুধু চুল কাটানো ছাড়াও প্রতিদিন যেতাম পত্রিকা পড়ার জন্য। কিন্তু একদিন হঠাৎ করে পরিমল দার সঙ্গে একটা কারণে সম্পর্ক খারাপ হয়ে গিয়েছিল। এর পর থেকে আর কখনো উনার সেলুনে যাই নাই। কারণটা ছিল আমি একদিন দাদার কাছে মহাভারত চাইলাম। দাদা মহাভারত দেন নাই, এটা আমার আত্মসম্মানে লাগলো। কেন দেন নাই সেটা এখন বুঝি, আমার কাছে যদি তখন কেউ কোরান শরীফ চাইত আমিও অবশ্যই দিতাম না। বাংলা অনুবাদ হলেও দিতাম না। সেই গল্প আরেকদিন আজ সেলুনেই সীমাবদ্ধ থাকি।
আমাদের গ্রাম থেকে দুঃসম্পের্কর কাকা, জুয়েল কাকা আসতেন। দুইতিন মাস পর পর তিনি আসতেন শুধু মাত্র চুল কাটানোর জন্য। চুল কাটাতেন মোহাম্মদপুরে। আমরা যেখানে চুল কাটাতাম ১০/১২ টাকা দিয়া। তিনি তখন চুল কাটাতেন ১০০ টাকা দিয়া। প্রচ- সৌখিন একটা মানুষ ছিলেন। আর কাকা ঢাকা আসলে আমাদের অনেক আনন্দ হতো। কারণ তিনি আমাদের সব সময় স্কুলের কাছের দোকানে নিয়ে গিয়ে চটপটি খাওয়াতেন। শুধুমাত্র চুল কাটানোর জন্য তিনমাস পর পর গ্রাম থেকে ঢাকা আসেন এমন লোক অবশ্যই বিরল।
পরিমাল দার দোকান ছাড়ার পরে যে দোকানে চুল কাটাতাম সেটা ছিল সাইদুল মামার দোকান। ঐ দোকানের নামটাও মনে নাই। কিন্তু কার দোকানে চুল কাটাতাম সেটা মনে আছে। স্কুলে বড় চুল রাখতে দিত না। কিন্তু চুল বড় রাখার বাসনা ছিল দীর্ঘ দিনের। সাইদুল মামার কাছে গেলে তিনি এমনভাবে চুল কাটতেন যেন চুল যে বড় সেটা না বুঝা যায়, কিন্তু চুল ঠিক সামনের দিকে বড় থাকতো। মামা চুল আচরিয়ে দেখিয়ে দিতেন কিভাবে চুল আচরালে স্যাররা বুঝতে পারবেন না, ছোট না বড়। এভাবেই অনেকদিন মামার দোকানে চুল কাটাতাম।
কাজের কারণে যখন এলিফ্যান্ট রোডে আসলাম কাজ করতে তখন দেখি এখানে অনেক স্বাধীনতা। রাসেল ভাইকে দেখি লম্বার চুল রাখেন, সলিমুল্লাহ স্যারেরও চুল লম্বা। চিন্তা করলাম স্যাররা তো হর্তাকর্তা তাদের সমস্যা কি? কি মনে করে রাসেল ভাইকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ভাইয়া আমার তো লম্বা চুল রাখার অনেকদিনের সখ, আমিও যদি চুল লম্বা রাখি এখানে কেউ কিছু বলবে না তো?’
জানতে পারলাম এখানে তেমন কোন বাধ্য-বাধকতা নাই। এমনকি চাইলে হাফ প্যান্ট পরেও অফিস করা যায়। বলা যায় ব্যক্তিগত পোশাক-আশাকের বিষয়ে কোন আদেশ-নির্দেশ নাই। যে যা ইচ্ছা তাই পরতে পারে কোন সমস্যা নাই। সবাই অফিসে আসে ১১ টার পরে। শুক্রবার ছাড়া আমরা যারা কাজ করি তারা ছাড়া অফিসে কেউ থাকেও না। মূল কাজকর্ম শুরু হয় আসলে বিকালের পরে। সকালে অফুরন্ত সময়।
আমার সখ-আহ্লাদ অনেক কিছুই পূরণ করা শুরু করলাম। লম্বা চুল, কখনো কখনো খোচা খোচা দাড়ি, কখনো একটু বড় দাড়ি। যা ইচ্ছা তাই করা যায়। শার্ট না পরলেও কেউ কিছু বলে না। অফিসে ঢুকার পরেও প্রতি সপ্তাহে নাখাল পাড়া যেতাম। মাসে এক দুইবার সাইদুল মামার সেলুনে যেতাম। মামা বলতেন কিছুদিন পর পর চুলের আগা কাটাতে হবে তাহলে চুল তাড়াতাড়ি লম্বা হবে। সাইদুল মামার কথামতো পনের দিন পর পর যেতাম চুলের আগা কাটাতে। বিনিময়ে তিনি চুল কাটার অর্ধেক টাকা নিতেন। নানা রকম গল্পগুজব করে ফিরে আসতাম।
আজ অনেকদিন পরে বাসা থেকে বের হয়ে দেখলাম ‘সুপার কার্ট সেলুন’ আগে নাম ছিল সম্ভব ‘জেন্টস কার্ট সেলুন’। এই সেলুনটা বেশ বিখ্যাত বলা যায় মোহাম্মদপুরে। বয়স ২০ বছরের উপরে, কম বেশিও হতে পারে। সম্ভবত এখানেই জুয়েল কাকা গ্রাম থেকে আসতেন চুল কাটাতে। অন্য কোথায়ও হতে পারে। সেটা বড় বিষয় না। বড় বিষয় হলো হঠাৎ মনে পড়লো আমি প্রায় বছর দশেক হলো কোন সেলুনে ঢুকি না। দশ বছর তো অনেক সময় বলা যায়। এখন চুল কাটাতে কত লাগে তাও জানি না, দাড়ি কাটাতে কত লাগে তাও জানি না। আশ্চর্য তো!
১৮ পৌষ ১৪২৪
