স্পেলবাউন্ড

এই জীবনে প্রথম যে করপরেট অফিসে কাজ করেছিলাম সেই প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল স্পেলবাউন্ড। এক বড় ভাই রাব্বানি ভাইয়ের মাধ্যমে সেখানে গিয়েছিলাম। কাজটা ছিল অক্ষর বিন্যাসের। মূলত ডিসিসিআইয়ের একটা এনুয়াল রিপোর্টের বই বের করবে, প্রায় ১৮০ পাতার বই। সেটার জন্য বাংলায় কম্পোজ করে দিতে হবে। সেখানে গিয়ে পরিচয় হয়েছিল কয়েকজন অসাধারণ মানুষের সঙ্গে। রুম্মন ভাই, রেজা ভাই, বেলায়েত ভাই। আরো অনেকের সঙ্গে যাঁদের নাম মনে নাই।

আমার তখন কম্পোজে স্পিড ছিল খুবই কম। সেই কাজটার জন্য প্রচুর খেটেছিলাম। এখনো মনে আছে ঐ অফিসে ঢুকে আমি সাতদিন বের হই নাই। সাতটা দিন টানা কাজ করেছি দুই কি তিন ঘণ্টা ঘুমিয়েছি। সাতদিন সূর্যের আলো দেখি নাই। শান্ত ভাই নামে একজন ছিলেন, তিনি খাবার নিয়ে আসতেন বাইরে থেকে। রাতে সেখানেই একটা টয়লেটে গোসল করে ফেলতাম।

গেস্ট রুমে একটা বাতাসওয়ালা সোফা ছিল সেটাতে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম। ঐ বইয়ের কাজ করার পরেও কিছু টুকটাক কাজ করে দিয়েছিলাম। এর মধ্যে একবার উত্তরবঙ্গে একটা ট্যুরও করে এসেছিলাম। সেই প্রোগ্রামের নাম ছিল ‘মঙ্গা মুক্তির মিছিল’। সেখানে দুইজন অসাধারণ মানুষের কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। একজন তারামন বিবি, বীর প্রতীক। আরেকজন সুফিয়া কাঙ্গালি। অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছিল স্পেলবাউন্ডে কাজ করে।

আমার তোলা তারামন বিবির ছবি।

কাজ শেষ করার পরে বিল নেয়ার সময় আমি যা চেয়েছিলাম, রুম্মন ভাই তার চাইতে ডাবল টাকা দিয়েছিলেন। আমি তখন বড় একটা ধাক্কা খেয়েছিলাম। কেউ কখনো চাহিদার ডাবল টাকা দিতে পারে! রুম্মন ভাই বলেছিলেন, ‘শরীফ তুমি থেকে যাও, আমাদের সঙ্গে কাজ করো। তুমি যা বেতন চাও তাই দিব, টাকা নিয়ে চিন্তা কইর না।’

সেই দিন প্রথম মনে হলো কাজটা বোধহয় আমি ভালই করি। তা নাহলে নিশ্চয়ই রুম্মন ভাই এভাবে বলতেন না। কিন্তু কোন এক অজানা কারণে কর্পরেট কালচারটা আমাকে টানে না। আমি একদমই আনন্দ পাই না। আমি যে কোন কাজেই আনন্দ খুঁজে নিতে পারি। কিন্তু এঁদের সংস্কৃতিটা আমার ঠিক ভাল লাগে না।

তখন যদি স্পেলবাউন্ড থিতু হতাম তাহলে সম্ভবত অনেক আনন্দ হতে বঞ্চিত হতাম। বিশেষ করে এখন যেসব কাজ করে আত্মতৃপ্তি পাই সেটা হয়তো পেতাম না। কিন্তু টাকা হয়তো ভালই পেতাম যদি তখন থিতু হতাম। স্পেলবাউন্ড মূলত অ্যাডফার্ম টাইপের একটা প্রতিষ্ঠান ছিল। ‘টেস্ট অফ ঢাকা’ আরো কি কি যেন প্রোগ্রাম করতো। প্রোগ্রামগুলা ইন্টারেস্টিং ছিল। রুম্মন ভাইয়ের সম্ভবত আমাকে দিয়ে কোন একটা প্ল্যান ছিল, বিশেষ করে ট্যুরিজম বিষয়ে।

স্পেলবাউন্ড ছাড়াও কয়েকটা অ্যাডফার্মে কাজ করে এমন লোকজন পরিচিত ছিল। এদের সঙ্গে আমার অভিজ্ঞতা খুবই খারাপ। আমার পরিচিত যে কয়জন আছেন যারা অ্যাডফার্মে কাজ করেন, তারা খুবই ধূর্ত টাইপের। সুন্দর করে মিথ্যা বলতে পারেন। সম্ভবত আমার কপালটাই খারাপ। ভাল মানুষ না পাওয়াতে অ্যাডফার্মের উপর একটা অনাস্থা তৈরি হয়েছে। কর্পরেট লেবেলে কাজ করলে হয়তো অন্য অনেকের মতো অসাধারণ জীবনযাপন করতে পারতাম। অসাধারণ জীবনযাপন না করে সাধারণ হয়ে ভালই আছি। কারণ এই অসাধারণ জীবনযাপন করেন খুব মানুষই। হয়তো ১০% বা বেশি হলে ১৫%। বেশির ভাগ মানুষই তো সাধারণ কৃষক বা শ্রমিক শ্রেণির লোকজন। আমার সাধারণ থাকতেই ভাল লাগে। অথবা অসাধারণ হওয়ার কোন যোগ্যতাই আমার নাই। তাই নিজের অক্ষমতা ঢাকার জন্য নিজেকে সাধারণ ভেবে আত্মতৃ্প্তিতে ভুগতেছি।

 

১৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৫

Comments

comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.