স্বপ্নপূরণ–নৌকায় ঢাকা থেকে সেন্টমার্টিন (১)

সকল ভ্রমণসঙ্গীরা একসঙ্গে
ভ্রমণসঙ্গীরা

‘ভ্রমণ বাংলাদেশ’ বাংলাদেশের অন্যতম অ্যাডভেঞ্চার ক্লাবের একটি। ‘ভ্রমণ বাংলাদেশে’র টুটু ভাই ডিসেম্বরের ১০ তারিখের দিকে আমাকে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘সেন্টমার্টিনের রেসকিউ স্কুভা ডাইভিংয়ের মুজিবর রহমান একটি নৌকা কিনেছেন। তিনি আমাকে অনুরোধ করেছেন এটা সেন্টমার্টিন পাঠানোর জন্য সাহায্য চেয়েছেন। এই কথা শুনে আমার মাথায় প্ল্যান আসছে। ভ্রমণ বাংলাদেশের কয়েকজনকে নিয়ে একটি নৌকা ভ্রমণের আয়োজন করবো ঢাকা থেকে সেন্টমার্টিন। তুমি যাবা?’ আমাকে জিজ্ঞেস করার সঙ্গে বলে ফেললাম, ‘অবশ্যই। আমি এক পায়ে খাড়া।’ নদী, সমুদ্র পার হয়ে যেতে হবে, অনেক ভয় এবং বিপদজনক ব্যাপার। বিপদ মানেই তো অ্যাডভেঞ্চার। অনেকটা অ্যাডভেঞ্চারের লোভেই আমি রাজি হয়ে গেলাম।

আমাদের নৌকার সাইজ ছিল ২২ ফিট/৮ফিট। সঙ্গে জেনারেটর, তাবু, স্লিপিং ব্যাগ, চুলা, সিলিন্ডারসহ নানা রকম প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। এইসব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ১০/১২ দিনের জন্য খাওয়ার জন্য বাজার। সবকিছু নিয়ে যেতে আমাদের একটা ভ্যান ভাড়া করতে হয়েছে। আর সবকিছু যোগার করতে পুরো এক সপ্তাহ লাগলো। ভ্রমণের একদিন আগে আমরা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নৌকায় রেখে আসলাম।

আমাদের ছোট্ট নৌকাটি
আমাদের ছোট্ট নৌকাটি

প্রথম দিন
১৯ ডিসেম্বর ভোর সাড়ে ছয়টার দিকেই পৌঁছে গেলাম সোয়ারী ঘাট। নৌকার কাছে গিয়ে দেখি আমিই সবার প্রথমে এসেছি। আস্তে আস্তে প্রথমে রাহাত ভাই, বাবু ভাই এবং পরে খোকন ভাই, টুটু ভাই, আনোয়ার ভাই, রিমন ভাই সব শেষে মুজিব ভাই এসে আমাদের সাথে যোগ দিলেন। আমাদের সঙ্গে আরো ছিল মাঝি দ্বীন ইসলাম এবং মাঝির সহকারী মো: শফিক। আমাদেরকে বিদায় দেয়ার জন্য ভ্রমণ বাংলাদেশের অনেক সদস্য হাজির, মনা ভাই, সনি ভাই, আফতাব ভাই, রুম্মন ভাই, শম্পা আপা, রুমা আপা, সালমা আপা দুইএকজনকে চিনিওনা। সবার সঙ্গে কথাবার্তা বলে বিদায় জানিয়ে রওনা দিতে দিতে সাড়ে দশটা বেজে গেল। আমরা ঢাকা থেকে সেন্টমার্টিনের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলাম। সোয়ারী ঘাট থেকে রওনা দিয়ে পোস্তগোলা ব্রিজ হয়ে মেরী এন্ডারসন, পাগলা। ফতুল্লায় পৌঁছাতে পৌঁচাতে বেলা বারটা বেজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। আমরা ২-৩ জন নেমে পড়লাম খাবার পানি আনার জন্য। নৌকায় উঠেই টুটু ভাই আমাকে প্রধান দায়িত্ব দিলেন নৌকার তেল কেনার জন্য। যেন আমি জ্বালানী মন্ত্রী। শুধু একটা মন্ত্রণালয় দিলেও হতো সঙ্গে আরো যুক্ত করে দিলেন খাবার পানিও যোগার করতে হবে। অবশ্য সঙ্গে জুরে দিলেন রাহাত ভাইকেও। ফতুল্লা থেকে তেল কিনে খাবার পানি নিয়ে আমরা আবার রওনা দিলাম।

আবহাওয়া ঠাণ্ড, চারিদিকে হালকা কুয়াশা, সূর্য মামাকে দেখা যাচ্ছে না। এর মধ্যে টুটু ভাই এবং আনোয়ার ভাই রান্নার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আসেপাশের কোন কিছুই টুটু ভাইকে তেমন আকর্ষণ করলো না। যেন আমাদের রান্না করে খাওয়াতে পারলেই তিনি খুশি। এদিকে বাবু ভাই তাঁর ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে ব্যস্ত। আমরা সবাই নদীর আশেপাশের দৃশ্য দেখছি, মাঝে মাঝে আমি রাহাত ভাইয়ের ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলছি। দুপুর দুইটার দিকে মুন্সিগঞ্জ সেতুর কাছে পৌঁছালাম। টুটু ভাইয়ের ঘোষণা খাবার প্রস্তুত। প্রথমদিন প্রথম খাবার, আমরা সবাই খাওয়ার জন্য বসে পড়লাম। খাবারের আয়োজন ছিল খিচুরি আর ডিম ভাজা। আমাদের খাওয়াও চলতে থাকলো নৌকাও চলতে থাকলো। আমরা মতলবের কাছাকাছি চলে আসি তখন ঘড়িতে বাজে পাঁচটা পয়তাল্লিশ মিনিট, তখন সূর্য অস্ত যাওয়ার সময়। কিছুদূর যাওয়ার পর হঠাৎ করে আমাদের নৌকার ইঞ্জিনের বেল্ট নষ্ট হয়ে গেলো, ঘড়িতে তখন প্রায় সাড়ে ছয়টা। প্রথম দিনেই একটা বিপদ।

আমাদের মাঝি দ্বীন ইসলাম আমাদের নৌকা তাড়াতাড়ি তীরের কাছাকাছি নিয়ে গেলো। আমরা কি করব বুঝতে পারছিলাম না। এমন সময় পাশ দিয়ে একটি ইঞ্জিল চালিত ট্রলার যাচ্ছিল। আমরা সেই নৌকার মাঝির কাছে সাহায্য চাইলাম, তাঁদের কাছে অনুরোধ করলাম আমাদের যেন সামনের ঘাটে পৌঁছে দেয়। ট্রলারের লোকগুলো রাজি হল। আমাদের নৌকা ট্রলারের সঙ্গে বেঁধে দেয়া হল। সেই ট্রলারের পেছনে পেছনে আমরা এগিয়ে যেতে থাকলাম। চারিদিকে অন্ধকার হয়ে গেছে, রিমন ভাই তাঁর কেরোসিন দিয়ে চালিত জেনারেটর চালানোর প্রস্তুতি নিলেন। কিছুক্ষন পর আমাদের নৌকা আলোকিত হয়ে গেল। আমরা সবাই যার যার মোবাইল চার্জ দিতে ব্যস্ত পড়লাম। আমাদের নৌকাকে যে ট্রলার টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, তাঁরা অবাক হয়ে দেখল এই ছোট্ট নৌকাতে বিদ্যুৎও আছে।

মতলব থানার ফরাজি কান্দি নামে একটি ঘাটে আমাদেরকে পৌঁছে দিল সাহায্যকারী ট্রলার। আমরা সেখানে পৌঁছে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম! যাক অন্তত রাতটা এখানে কাটানো যাবে, সকালে উঠে একটা ব্যবস্থা করা যাবে। টুটু ভাই বৈদ্যুতিক বাতির আলোতে রান্নার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, যেন রান্না না করলে তাঁর ছেলেরা না খেয়ে অনেক কষ্ট পাবে। তাঁর সঙ্গে সহকারী হিসেবে খোকন ভাই আর আনোয়ার ভাই সবসময় হাজির। এছাড়াও টুটু ভাই খোকন ভাইকে বাজারের দায়িত্ব দিয়ে রেখেছেন নৌকায় উঠা আগেই, অর্থাৎ আমরা নৌকার যে বাজার করেছি, এর বেশির ভাগ বাজার খোটন ভাই-ই করেছেন। অর্থাৎ এই ভ্রমণের খাদ্রমন্ত্রী খোকন ভাই। তখন তাঁর সঙ্গী হিসেবে আমি ছিলাম। অবশ্য সবকিছুর তালিকা টুটু ভাই-ই করে দিয়েছিলেন।

রাতের খাওয়ার পর, থালাবাসন ধোয়ার দায়িত্ব পড়ল আমার কাধে, সঙ্গে সঙ্গী হিসেবে সবসময় রাহাত ভাই। সবকিছু পরিষ্কার করে আবার সেই খাবার পানি আনার কাজ। বাজার থেকে টিউবওয়েল থেকে খাবার পানির গ্যালনগুলো ভরা হল। তারপর সবাই মিলে ঘুমোবার আয়োজন করলাম। নৌকার ছাদেই চারিদিকে পলিথিন, উপরে পলিথিন দিয়ে থাকার ব্যবস্থা করা হল। পলিথিন লাগানোর দায়িত্ব রিমন ভাইয়ের সঙ্গে দুইএকজন সাহায্য করলেন। মাঝিরা ইঞ্জিন রুমে, আমরা পাঁচ/ছয় জন নৌকার ছাদে। বাকিরা নৌকার ভিতরে। ঘুমানোর আগে টুটু ভাই ঘোষণা দিলেন, রাতে পাহারা দিতে হবে। প্রথমে দায়িত্ব দেয়া হল মাঝরাত অর্থাৎ রাত ২/৩ টা পর্যন্ত রাহাত ভাইকে পাহারা দেয়ার জন্য। তারপর টুটু ভাইকে ডেকে দিলে তিনি পাহারা দিবেন।

আমি সবার ছোট তাই আমাকে এই গুরুত্বপূর্ণ দ্বায়িত্ব দেয়া থেকে বিরত থাকলেন। রাতে বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে তাই তাড়াতাড়ি আমি স্লিপিং ব্যাগের ভেতর ঢুকে পড়লাম।

এই লেখাটির আংশিক দৈনিক কালেরকণ্ঠ এবং বাংলা বাজার পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল।

দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
চতুর্থ পর্ব
শেষ পর্ব

Comments

comments

Comments

  1. md.nizamul haque

    অ্যাডভেঞ্চার আমার ভাল লাগে তাই আপনাদের অ্যাডভেঞ্চারের গল্পটা মনদিয়ে পড়লাম কিন্তু পুর গল্পটানেই বলে খারাপ লাগলো তবে জতটুক বুজলাম খুব আনন্দ হয়েছে।

  2. মাহবুব

    ইসস.. শুরু না করতেই শেষ হয়ে গেল। একেবারে মন্ত্রমুগ্ধের মত পড়ছিলাম। পরের পর্ব তাড়াতাড়ি দিবেন।

    অট: রাহাত ভাই কি BDC এর মাইনুল ইসলাম রাহাত?

    1. জ্বি ভাই দ্রুতই দেয়ার চেষ্টা করছি।

      না ভাইয়া ঐটা বিডিসির রাহাত ভাই না। ঐটা টিওবি (https://www.facebook.com/groups/mail.tob/) পিতা মানে ট্যাভেলার্স অফ বাংলাদেশ যে প্রতিষ্ঠা করেছেন সেই রাহাত ভাই মানে জামান রাহাত খান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.