স্বপ্নপূরণ–নৌকায় ঢাকা থেকে সেন্টমার্টিন (২)

4247_1132150073838_5549007_n

দ্বিতীয় দিন
সকালে ঘুম থেকে উঠলাম ৮টার দিকে। উঠে দেখি সবাই ঘুম থেকে উঠে গেছে। আমিই সবার শেষে উঠলাম। বাজারে দেখলাম একটি মিছিল যাচ্ছে, নির্বাচনী প্রচারণা মিছিল। আমাদের নৌকা তখনও ঠিক হয় নাই। মাঝি দ্বীন ইসলাম বাজার থেকে ঘুরে এসেছে, এই বাজারে কোন মিস্ত্রি নাই। মিস্ত্রি ছাড়াও যেই জিনিষটা প্রয়োজন ছিল সেটা হলো ইঞ্জিনের জন্য বেল্ট। বাজারে বেল্টও খুঁজে পাওয়া গেল না।

রিমন ভাই আর দ্বীন ইসলাম অনেকক্ষণ ইঞ্জিন নিয়ে গুতাগুতি করলেন। হঠাৎ রিমন ভাইয়ের মাথায় ম্যাকগাইভারি বুদ্ধি আসলো। একটা দড়ি দিয়ে রিমন ভাই আর দ্বীন ইসলাম বেল্ট বানিয়ে ফেললেন। ঠিক করলো চাঁদপুর যাওয়ার পর ভালো মত ঠিক করতে হবে। তবে নৌকা চালাতে হবে আস্তে আস্তে। কারণ জোরে চালালে দড়ির বেল্ট ছিড়ে যেতে পারে। বাজার থেকে সকালের নাস্তা করে আমরা রওনা দিলাম চাঁদপুরের উদ্দেশে।

ফরাজি কান্দি থেকে চাঁদপুর খুব বেশি দূরে নয়। নৌকা ঠিক থাকলে এক ঘণ্টা লাগতো, যেহেতু নৌকা ঠিক নাই তাই আস্তে আস্তে যেতে হবে এবং সময়ও একটু বেশি লাগবে। চাঁদপুরে পৌঁছানোর পর মিস্ত্রি আনা হলো । মিস্ত্রি নৌকা দেখে ঘোষণা দিলেন কাজ শেষ করতে করতে বিকাল হয়ে যাবে। কারণ নৌকায় আরো অনেক সমস্যা আছে সব ঠিক করতে সময় লাগবে। নৌকার পুরনো চাপকলটা পরিবর্তন করে নতুন একটা কল লাগাতে হবে। এই কল দিয়ে নৌকার পানি ফেলা হয়। সময় বেশি লাগার কারণে আমাদের হাতে অফুরন্ত সময়। বিকাল পর্যন্ত কোন কাজ নেই।

চাঁদপুর
চাঁদপুর

রাহাত ভাই আর আমি টুটু ভাইয়ের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে বের হলাম শহর দেখতে। টুটু ভাইকে বলে আসলাম বিকেলে আসবো। চাঁদপুরে রাহাত ভাইয়ের কয়েকজন বন্ধু আছেন, তাঁরা মোবাইল কোম্পানিতে কাজ করেন। তাঁদের সাথে দেখা করলাম, অনেক্ষণ আড্ডা দিলাম। বিকেলের দিকে নৌকায় ফিরে আসলাম। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে রিমন ভাইয়ের সাথে আবার বের হলাম হাঁটাহাঁটি করতে। বেরিবাধের উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম সুন্দর একটা যায়গায় যার নাম ঠোটের মাথা। বাধ ধরে এখানে পার্কের মতো সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে অনেক গাছপালা আছে। লোকজনদের বসার জন্য বেঞ্চও পাতা আছে। আমার মনে হয় চাঁদপুরে সুন্দর বিকেল কাটানোর জন্য এর চাইতে সুন্দর জায়গা খুঁজে পাওয়া যাবে না। ঠোটের মাথা ডাকাতিয়া নদীর মোহনায়। এখান দিয়েই চাঁদপুর ঘাটের দিকে লঞ্চ ঢুকে।

ঠোটের মাথা থেকে ফিরে দেখি নৌকার ইঞ্জিল ঠিক হয়ে গেছে। আমাদের আর আগামীকাল যাত্রা করতে কোন বাধা রইল না।

তৃতীয় দিন
ঘুম থেকে উঠেই আমি আর মাঝি দ্বীন ইসলাম চলে গেলাম নৌকার তেল আনার জন্য। খোকন ভাই চলে গেল সকালের নাস্তা আনার জন্য। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নৌকায় তুলে আমরা যাত্রা শুরু করলাম। ঘড়িতে আটটা বেজে ত্রিশ মিনিট, নদীতে ঘন কুয়াশা বেশিদূর কিছু দেখা যায় না। তাই নৌকা আস্তে আস্তেই চালাতে হচ্ছে। কিছুদূর যাওয়ার পর পড়লো হাইম চর। কুয়াশা আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছে এখন দূরের অনেক কিছুই দেখা যাচ্ছে। নদীতে জেলেরা মাছ ধরছে। হাইম চর পার হওয়ার সময় হঠাৎ করে আমাদের নৌকার ইঞ্জিনের পাখা আটকালো স্থানীয় জেলের জালে।

4247_1132404440197_3551718_nতাঁরা সেখানে মাছ ধরছিল। আমাদের মাঝি জাল দেখতে পায়নি। সেখানে জেলেরা জাল থেকে মাত্র ইলিশ মাছ তুলে নৌকায় তুললেন,আমরা দেখে খুবই অবাক! মাছ তখনও জীবিত। মাছ নৌকায় উঠানোর পরেই মাত্র ত্রিশ সেকেন্ড এক মিনিটের মধ্যে নিস্তেজ হয়ে গেল। ইলিশ মাছ সূর্যের আলোয় বেশিক্ষণ বাঁচে না। মাঝিরা মোটামুটি ভয় পেয়ে গেছেন আমাদের দেখে। কারণ তাঁরা ভেবেছেন আমরা নৌবাহিনীর লোক। তাঁদের যে জাল আমাদের নৌকার পাখায় আটকে গেছে সে জাল ছিল কারেন্ট জাল। তাই তাঁরা একটু বেশিই ভয় পেয়েছিলো। আমাদের সঙ্গে স্যার স্যার বলে কথা বলছিলো।

সূর্য ডুবছে
সূর্য ডুবছে

মাঝি দ্বীন ইসলাম আর টুটুল ভাই কথা বলে আমাদের জন্য মাত্র দেড়শত টাকায় চারটা ইলিশ কিনে ফেললেন। এত কম দামে ইলিশ আর কেউ কিনেছে কিনে আমার সন্দেহ আছে। দুপুরে তাজা ইলিশ মাছ দিয়ে খাওয়া শেষ করলাম। মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে ধরা মাছ খেতে অসাধারণ। ঢাকার মাছের সঙ্গে এই মাছের কত পার্থক্য তা না খেলে বোঝানো মুশকিল।

কোন ধরনের ঝামেলা ছাড়াই আমরা এগিয়ে যাচ্ছিলাম হঠাৎ করে বিকেলের দিকে আমাদের নৌকা চরে আটকে গেল। অনেক চেষ্টা করেও সেখান থেকে বের হওয়া যাচ্ছিলো না। নৌকা থেকে একজন একজন করে নামা শুরু করলেন ধাক্কা দেয়ার জন্য। রাহাত ভাই সাতার জানেন না তাই তিনি লাইফ জ্যাকেট পরেই লাফ দিলেন। আমিও সাতার জানি না পানি অনেক কম তাই আমিও নেমে পড়লাম লাইফ জ্যাকেট ছাড়া। অনেক ধাক্কা-ধাক্কি করেও নৌকা নারানো গেল না। বাধ্য হয়ে সবাই নৌকায় উঠে পড়লাম। অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই, জোয়ার আসলে তারপর হয়তো আমরা এখান থেকে যেতে পারবো। জোয়ারের জন্য রাত সাতটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হল। এত রাতে আমরা সামনে যেতে পারবো না এটা নিশ্চিত, তাই তীরের দিকে নৌকা নোঙ্গর করা হল। রাতে এখানেই থাকার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো।

এই অজানা চরে আটকানোটা হয়েছে একদম আমাদের মাঝির জন্য। মাঝি দ্বীন ইসলাম বলেছিল সে সব কিছু চেনে। আসলে সে কিছু চেনে না। সে একটা মহা চাপাবাজ। চাঁদপুরের পরে সে কিছুই চেনে না। তার বাড়ি চাঁদপুর, চাঁদপুরের পরে ঐ দিকে সে কখনো যায় নাই। আমাদের কাছে এখন পুরোপুরি পরিষ্কার হয়ে গেলো।

রাহাত ভাই আর আমি
রাহাত ভাই আর আমি

রাতে পাহারা দেয়ার জন্য রিমন ভাই জেগে রইলেন। রাত ১০টার দিকে হঠাৎ করে রিমন ভাই টুটু ভাইকে ডাকাডাকি শুরু করলেন, ‘টুটু ভাই কে জানি আমাদের নৌকায় লাইট মারতেছে। ডাকাত নাতো?’ গত রাতে আমাদের মাঝি বলাবলি করছিলেন চর এলাকায় ডাকাতের আড্ডা হয়। কিছুক্ষণ পর পর নৌকায় আলো আসতে থাকলো। চিৎকার-চেচামেচিরও শব্দ, আমরা সবাই নৌকায় আলো বন্ধ করে চুপাচাপ বসে আছি। টুটু ভাই গ্যাসের সিলিন্ডার নৌকার সামনে এনে রেখে দিলেন। এই কয়দিনে রাহাত ভাইয়ের অনেক কাছের মানুষ হয়ে গেছি, এর আগে রাহাত ভাইয়ের সঙ্গে হয়তো দেখা হয়েছে কিন্তু এত ক্লোজ ছিলাম না। রাহাত ভাই অথবা আমি যাই করি আমরা দুইজনে এক সাথেই সবকিছু করি। একসাথে পাশাপাশি ঘুমাইও। পাশ থেকে রাহাত ভাই আমাকে বললেন ‘তুই চুপচাপ শুয়ে থাক, ডাকাত আসলে আমরা কি কিছু করতে পারবো? তুই ঘুমা, ডাকাত আসলে দেখা যাবে।’ টুটু ভাই বিড়বিড় করে বলছিলেন, ‘আগে জানলে তো দুই একটা মেশিন (অস্ত্র) নিয়াই আসতাম!’ মনে হলো তিনি কিছুটা আফসোসও করলেন মেশিনের অভাবে।

সারারাত কেউই তেমন ঘুমাতে পারলো না। কিছুক্ষণ পর পর দূর থেকে শব্দ আসে, কে যেন টর্চের আলো দেয়। এভাবে ঘুমানো যায় না!

প্রথম পর্ব
তৃতীয় পর্ব
চতুর্থ পর্ব
শেষ পর্ব

Comments

comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.