
চতুর্থ দিন
ভোরে ঘুম থেকে উঠলাম তখন ঘড়িতে ৬ বেজে ৩০ মিনিট। সেই নাম না জানা চর থেকে রওনা দিলাম ৬ টা ৪৫ মিনিটে। অল্প কিছুদূর যাওয়ার পরেই বাজার দেখতে পেলাম। সেখানে নির্বাচনী প্রচারণার মিছিল যাচ্ছে। বুঝতে পারলাম গতকালের চিৎকার আসলে মিছিলের। শুধু শুধু আমরা ভয়ে ছিলাম!
প্রায় এক ঘণ্টা চলার পর পৌঁছালাম চর আলেকজেন্ডার নামে এক জায়গায়। চরের নাম আলেকজেন্ডার কেনো? এটা একটা বড় প্রশ্ন। এখানে নিশ্চয়ই আলেকজেন্ডার আসে নাই। এইসব নিয়ে বেশি চিন্তা করার কারো সময় নেই। আমরা নদীর দৃশ্য দেখতেই ব্যস্ত, দেখলাম এক জেলে পরিবার, পরিবারের সবাই নৌকাতেই থাকে। কিছুদূর যেতেই এরকম আরেকটি পরিবার দেখলাম সেখানে নৌকা চালাচ্ছেন এক মহিলা, মহিলার কোলে ছোট বাচ্চা। মাঝির কাছে জানতে পারলাম এঁদের ঘর-সংসার সব নৌকা কেন্দ্রিক। এক পরিবারের সঙ্গে আরেক পরিবারের সম্পর্কও হয় ঐ নৌকাকে কেন্দ্র করেই। চিন্তা করছিলাম, এঁদের সবকিছুই যদি নৌকা কেন্দ্রিক হয় তাহলে সামনে নির্বাচন তাঁরা কিভাবে ভোট দিবে? জাতীয় পরিচয় পত্র করতে হলে তো ঠিকানা দিতে হয়। এঁরা কোন ঠিকানা দিবে?
সকাল ৯ দিকে পৌঁছালাম রামগতি ঘাটে। রামগতি থেকে নতুন দুইজন মাঝি নেওয়া হল। কারণ আমরা আবার বিপদে পড়তে চাইনা। দুইজন নেয়ার কারণ তাঁরা একজন একা যাবেন না, তাই বাধ্য হয়ে দুইজনকেই নিতে হলো। বাজারে খোকন ভাই নামলেন সকালের নাস্তার জন্য সঙ্গে আমিও। দোকান থেকে রুটি একটু বেশি করেই কিনলাম, যাতে দুপুরেও খাওয়া যায়। কেনাকাটা শেষে আমাদের নৌকা আবার ছেড়ে দিলো।
এই দিকের বেশির ভাগ নামের আগেপরে চর নামটা থাকে। যেমন বড়ার চর, নামার চর ইত্যাদি। বড়ার চরের পর একটি বাজার পেলাম নাম টাঙ্গিবাজার। টাঙ্গিবাজার থেকে লোকজন বোঝাই একটি ট্রলার আমাদের পাশ দিয়ে চলে গেল। ট্রলারের লোক অবাক হয়ে আমাদের দেখছিলেন, যেন আমরা ভিন গ্রহের প্রাণী। টাঙ্গিবাজারের পর নামার চরে বিশাল এক মহিষের পাল দেখলাম। চরে বাবু ভাই নেমে গেলেন। আমাদের নৌকা নদী দিয়ে যাচ্ছে এই দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী হবে। টুটু ভাইয়ের ভাষায়, দৃশ্য বন্দী হওয়ার পাশাপাশি এই দৃশ্যের ক্যাসেট অথবা মেমোরি কার্ডও বন্দী হয়ে যাবে বাবু ভাইয়ের মহাফেজখানায়।

আমাদের নতুন মাঝিদের সঙ্গে কিছুক্ষণের মধ্যেই আলাপ জমিয়ে ফেললাম। তাঁদের কাছে জানতে পারলাম এখানকার বেশিরভাগ চরই ডাকাতদের দখলে থাকে। একেক চর একেক ডাকাতের দখলে। জায়গাগুলো বেশি দুর্গম হওয়ায় পুলিশ তেমন কিছু করতে পারে না। কয়েকজন ডাকাত সর্দারের সঙ্গে চেয়ারম্যান/এমপিদেরও আতাত আছে। তাই তারা কাউকে পরোয়া করে না।
এই ধরনের গল্প শুনতে শুনতে একসময় মাঝি ঘোষণা করলেন আমরা এখন সমুদ্রে চলে এসেছি। সমুদ্র অনেক শান্ত ছোট ছোট ঢেউ। মনে হয় না সমুদ্র। বেশ কিছু জেলের নৌকা মাছ ধরছে। এমন একটি নৌকা থেকে কথা বার্তা বলে দুপুরে খাওয়ার জন্য টুটু ভাই কিছু কিনে নিলেন। দুপুরে খেতে খেতে দুইটা বেজে গেলো।
বিকাল সাড়ে চারটার দিকে আমরা সন্দ্বীপ পৌঁছালাম। সেখানে দেখতে পেলাম নৌবাহিনীর একটি জাহাজ। নৌবাহিনীর জাহাজ দেখলেই যুদ্ধের কথা মনে আসে। এই ধরনের জাহাজে করে যুদ্ধ করে সেটা টেলিভিশনে অনেক দেখেছি। ছোট বেলা অস্ত্র মেলায় (সামরীক বাহিনীর প্রদর্শনী) জাহাজের ভিতরে কি আছে তাও দেখার সৌভাগ্য হয়েছিলো। তবে এটা ঐ জাহাজারে চাইতে অনেক আধুনিক। জাহাজের গায়ে লেখা এম-৯১।

তীর থেকে দূরে একটি উদ্ধারকারী জাহাজও দেখলাম। উদ্ধারকারী জাহাজের লোকজনদের কাছে জানতে পারলাম এখানে একটি চিনিবাহী জাহাজ ঢুবে গেছে তাই তারা ডুবে যাওয়া জাহাজটি উদ্ধারের চেষ্টা করছেন। আমাদের নৌকা উদ্ধারকারী জাহাজের সাথে বেধে দেওয়া হলো। সেখান থেকে তীরে যেতে হলে নৌকা নিয়ে যেতে হয়। উদ্ধারকারী জাহাজের সঙ্গে একটি ছোট নৌকাও বাধা ছিলো। সেটা দিয়ে আমরা তীরের দিকে রওনা দিলাম। খোকন ভাই যাবেন বাজার করার জন্য, আমি আর রিমন যাচ্ছি ঘুরতে। বাজারে গিয়ে আমি আর রিমন ভাই চানাচুর, জিলাপি, গজা এই ধরনের খাবার কিনে খেতে খেতে বিচ্ছিন্ন ভাবে বাজারে ঘোরাফেরা করছিলাম। বাজারে বেশিরভাগ দোকানেই নির্বাচন নিয়ে আলোচনা চলছে। প্রায় দুই বছর নির্বাচিত সরকারের জন্য নির্বাচন হচ্ছে, এর প্রভাব এতদূরেও পড়েছে। কিছুক্ষণ পরপর ছোট ছোট বাচ্চাদের ছোট ছোট মিছিল করছে। যেন তারাও এই নির্বাচনের একটা অংশ।
এভাবে ঘোরাফেরা করে আমাদের নৌকায় ফিরে আসলাম। উদ্ধারকারী জাহাজের লোকজনদের সঙ্গে অনেক্ষণ আড্ডা দিলাম। তাঁদের কাছে জানতে পারলাম ডুবে যাওয়া জাহাজ সন্ধান করে তোলা অনেক ব্যয়বহুল। বেশিরভাগ জাহাজ মালিকই এত খরচ করে জাহাজ তুলতে চান না। শুধু সরকারের চাপে তাঁরা তুলতে বাধ্য হয়। তাঁদের কাছে আরো জানতে পারলাম সরকার জাহাজ উদ্ধারের জন্য বেশি চাপ দেয় কারণ এই দিক দিয়ে অন্য আরেকটি জাহাজ গেলে সেটাও ডুবে যাওয়া জাহাজের সঙ্গে লেগে নতুন আরেক দুর্ঘটনার জন্ম নিতে পারে। আমরা যেখানে অবস্থান করছিলাম তার কয়েক ফিট নিচেই ডুবে যাওয়া জাহাজটি ছিলো।
রাতের খাওয়া শেষ করে বিছানা পাতার জন্য তৈরি হলাম। এবার আর নৌকায় না বড় জাহাজে তাবু করে থাকা। জীবনে প্রথম তাবুবাস। অন্যরকম এক অনুভুতি। প্রথমে ইচ্ছা ছিলো আমি আর রাহাত ভাই থাকবো। কিন্তু কোথা থেকে রিমন ভাই উড়ে এসে আমাদের তাবুতে জুড়ে শুয়ে পড়লেন। তিনিও আমাদের সঙ্গে থাকবেন, তিনি নৌকায় থাকতে রাজি না। তাই বাধ্য হয়ে আমি রাহাত ভাই ও রিমন ভাই একসাথে ঘুমালাম। অন্যরা সবাই নৌকায়।
পঞ্চম দিন
সকালে একটু দেরি করে উঠলাম ঘুম থেকে। আমাদের আজকের গন্তব্য বন্দর নগরী চট্টগ্রাম। নৌকা ছাড়ার আগে আমাকে আর রাহাত ভাইকে পানি আনার জন্য তীরে যেতে হলো। তীরে পানির জন্য কল খুঁজতে থাকলাম দুই জনে মিলে। প্রায় দশ মিনিট হাঁটার পর কল পেলাম। দুই জনের হাতে মোট সাতটা গ্যালন। সবগুলো গ্যালন ভরলাম। একসঙ্গে সাতটা নেয়া যাবে না, তাই দুইজনে প্রথমে চারটা নিলাম। দুই হাতে দুইটা করে। তীরের কাছে চারটা রেখে ফিরে গেলাম বাকি তিনটা নেয়ার জন্য।
কলের কাছে এসে দেখি তিনটা গ্যালন আছে ঠিকই কিন্তু গ্যালনে মুখ্যা নেই। চারিদিকে তাকিয়ে দেখি ধু-ধু করছে। কোথাও কাউকে দেখা গেল না, মনে হলো যেন ভূতে নিয়ে গেছে। ঠিক করলাম মুখ্যা যাক এমনিতেই নিয়ে যাই। তীরের কাছে ফিরে দেখি আগের চারটা গ্যালনেও মুখ্যা নেই। দুইজন দুইজনের দিকে তাকিয়ে আছি বোকার মতো। কিভাবে সম্ভব? আশেপাশেও কেউ নেই। যেন সত্যি সত্যি ভূতে নিয়ে গেছে! এত ভাবাভাবির সময় নেই, আমরা আমাদের নৌকায় যাওয়ার জন্য ছোট নৌকায় পানির গ্যালনগুলো তুলছিলাম। এমন সময় পেছন থেকে রাহাত ভাইয়ের পেন্ট ধরে পাঁচ/ছয় বছরের একটি ছেলে টানাটানি করছিলো। রাহাত ভাই তাকাতে তাঁর হাতে সবগুলো গ্যালনের মুখ্যা দিয়ে এক দৌঁড়। দূরে আরো কয়েকটি বাচ্চা দাঁড়িয়ে ছিলো ওরাও একসঙ্গে দৌঁড়। আমি আর রাহাত ভাই দুইজন দুইজনের দিকে তাকিয়ে হাসলাম।
আমরা বেশ কিছুক্ষণ ভাটার জন্য অপেক্ষা করলাম। অপেক্ষার পাশাপাশি উদ্ধারকারী জাহাজের লোকদের কাজ দেখছিলাম। তাঁরা অক্সিজেন মাস্ক পড়ে সিলিন্ডার কাধে নিয়ে নিচে চলে যাচ্ছিলেন। মুজিব ভাইয়ের কাছে জানতে পারলাম উনারা আন্ডারওয়াটারে কাজ করেন। মুজিব ভাইও এই কাজই করেন। বিভিন্ন জাহাজ অথবা লঞ্চ ডুবে গেলে মুজিব ভাইকে ডাকা হয়। মুজিব ভাইয়ের এই বিষয়ে দক্ষতা আছে। তিনি প্রাক্তন নৌবাহিনীর সদস্যও।
ভাটা আসার সঙ্গে সঙ্গে আমরা রওনা দিলাম। চারদিকে সমুদ্র, পানি আর পানি। পানি ছাড়া কিছুই দেখা যায় না, পানি খুব একটা পরিষ্কার না। আমি ভেবেছিলাম সমুদ্রের মাঝামাঝিতে পানি নীল হবে। কিন্তু আমার ভাবনা ভাবনাই রয়ে গেলো। মুজিব ভাইয়ের কাছে জানতে পারলাম সমুদ্রে মানুষ খালি চোখে পাঁচ থেকে ছয় কিলোমিটার দেখতে পারে। এর বেশি কারও পক্ষে দেখা সম্ভব না। যদি দূরবিক্ষণ যন্ত্র থাকে তাহলে আলাদা।

আমরা আরো কিছুদূর যাওয়ার পর বিশাল বিশাল জাহাজ দেখতে পেলাম। আমি আগে কখনও এতো বড় জাহাজ দেখিনি। একেকটা জাহাজ দশ থেকে পনের তলার সমান। অবাক হয়ে জাহাজ দেখতে দেখতে একসময় পতেঙ্গা বীচেরও দেখা পেলাম। আমরা চট্টগ্রাম পৌঁছালাম দুপুরের দিকে। আমাদের নৌকা ভিড়ানো হলো ১৫ নম্বর ঘাটে। সেখানে আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিলেন রামগতি থেকে আসা দুজন মাঝি। কারণ তাদের সাথে আমাদের কথা হয়েছিল চট্টগ্রাম পর্যন্ত। এখানে এসে আবার নতুন একজন মাঝি ঠিক করা হলো। তিনি আমাদের কক্সবাজার পর্যন্ত পৌঁছে দিবেন।
যথারীতি আমি চলে গেলাম নৌকার জন্য তেল আনার জন্য, সঙ্গী দ্বীন ইসলাম। বাবু ভাই গেলেন শহরে কিছু কাজ করবেন আর তাঁর ক্যামেরার ব্যাটারী কিনবেন। মুজিব ভাইও নৌকা থেকে নামলেন তিনি যাবেন ভাটিয়ারি। সন্ধ্যার দিকে সবাই ফিরে আসলেন, মুজিব ভাই সঙ্গে করে বেশ কিছু লাইফজ্যাকেট নিয়ে আসলেন। আমরা খাওয়ার পরে আড্ডা দিলাম তারপর ঘুম।
প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
চতুর্থ পর্ব
শেষ পর্ব
