স্বপ্নপূরণ–নৌকায় ঢাকা থেকে সেন্টমার্টিন (৪)

মহেশখালি
মহেশখালি

ষষ্ঠ দিন
খুব ভোরে উঠলাম ঘুম থেকে। ভোর না বলে রাত বলাই ভালো। চারিদিকে অন্ধকার, শুধু আশেপাশের ছোট ছোট জাহাজ থেকে কিছু আলো আসছে। আকাশের তাকিয়ে দেখি আকাশটা গাঢ় নীল। নৌকা স্টার্ট দেওয়ার এক মিনিটের মধ্যেই চট্টগ্রাম থেকে উঠা নতুন মাঝি ঘোষণা দিলেন হালে সমস্যা আছে, ঠিক মতো কাজ করছে না। প্রথমে দ্বীন ইসলাম লুঙ্গী কাছা দিয়ে নেমে পরলেন। দ্বীন ইসলাম জানালো হাল ভেঙ্গে গেছে, ঠিক করতে হবে। ঠিক করতে হলে পানির নিচে নামতে হবে। মুজিব ভাই স্কুবা ডাইভিংয়ের জিনিশপত্র, পোশাকআশাক পড়ে নেমে গেলেন। অকেক্ষণ গুতাগুতির পরে বললেন দড়ি লাগবে।

মুজিব ভাই স্নরকলিং করে হাল ঠিক করছেন।
মুজিব ভাই স্নরকলিং করে হাল ঠিক করছেন।

বাবু ভাই কি মনে করে, মাউন্টেনিয়াংয়ের দড়ি নিয়ে এসেছিলেন। সেই দড়ি দিয়ে নৌকার হাল ঠিক করা হলো। সময় লাগলো পাক্কা দুই ঘণ্টা। নৌকা ছেড়ে দিলো। সারাদিন নৌকায় বসে থাকা ছাড়া কোন কাজ নেই। রাহাত ভাই ব্যাগে করে কিছু বই নিয়ে এসেছেন, মাসুদ রানা আর কলকাতার এক লেখকের বই। বই পড়া, ছবি তোলা ছাড়া আমাদের কাজ কম। আনোয়ারা থানা পার হয়ে আমরা কুতুবদিয়ায় ঢুকলাম। ঘড়িতে তখন এগারটা, নাস্তাও খাওয়া শেষ। আশেপাশের দৃশ্যপটও পালটে যেতে লাগলো। আশেপাশের দৃশ্য টিভিতে দেখা সুন্দরবনের মতো লাগছিলো। মাঝি জানালো চকরিয়া সুন্দরবন।

এর মধ্যে নৌকার হাল আবার বেহাল হয়ে গেলো। নৌকা আবার তীরের কাছে রাখা হলো। মুজিব ভাই আবার নেমে গেলেন। দড়ির বাঁধন ঢিল হয়ে গেছে, টাইট দিতে হবে। মুজিব ভাই কাজ করছেন, বাবু ভাই তাঁর ভিডিও নিয়ে ব্যাস্ত। রিমন ভাই ঘোষণা দিলেন আমার অনেক গরম লাগতেছে গোসল করা দরকার। বলেই লাফ দিলেন, কিছুক্ষণ সাঁতার কেটে ফিরে আসলেন। প্রায় এক ঘণ্টা চেষ্টার পর হাল ঠিক হলো।

চকরিয়া সুন্দরবন
চকরিয়া সুন্দরবন

আবার নৌকা চলতে শুরু করলো, ঘড়িতে দেড়টা। পথে ওজোটিয়া জেটি ও পদ্মখালী ব্রিজ দেখলাম, নামগুলো মাঝি জানাচ্ছিলো। বিকাল পাঁচটার দিকে আমরা মহেশখালী থামলাম। সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো এখানেই রাত্রি যাপন করবো। নৌকা বাঁধা হলো আদিনাথ মন্দিরের জেটিতে। জেটিতে স্থানীয় লোকজন বিকালে বেড়াতে আসেন। বেড়াতে এসে আমাদের বোনাস হিসেবে দেখতে পেলেন। অনেকে কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেসও করলেন। সন্ধ্যায় ডিজেল আনতে আমি আর দ্বীন ইসলাম বাজারের দিকে রওনা দিলাম। জেটিতেই রিক্সা ছিলো, অল্পবয়সী রিক্সাওয়ালাও গল্প জুড়ে দিলো।

‘ভাই আপনারা কি সবাই ঢাকা থাকেন?‘

‘হ্যাঁ।’

‘আপনে কি করেন?’

‘আমি একটা অফিসে কাজ করি।’

‘কি কাজ করেন?’

‘এই তো আরেকজনের লেখা কম্পিউটারে লিখে দেই।’

কি মনে করে যেন বললাম, ‘আমি যাঁর সঙ্গে কাজ করি তিনি তো আপনাদের এলাকার, সলিমুল্লাহ খান, চেনেন?’

রিক্সাওয়ালা ভাই, রিক্সা থামিয়ে দিলেন, ‘বলেন কি! আপনে সলিমুল্লাহ খানের সঙ্গে কাজ করেন! তাঁরে চেনেনা কে? উনি অনেক গুনি মানুষ। অনেক পড়ালেখা জানা।’

এর পর থেকে আমাকে আর কিছুই বলতে হয় নাই। রিক্সাওয়ালা নিজে থেকেই কথা বলে যাচ্ছিলেন, ‘উনার বাড়ি সিপাহী পাড়ায়, উনার ছোট ভাই আছে সাদাত উল্লাহ খান, তিনি চেয়ারম্যান নির্বাচনে দাঁড়াইছিলেন, হারছে।’

‘আপনে তো দেখি অনেক কিছুই জানেন?’

‘হুমম জানি, উনার সম্বন্ধে সবাই জানে।’

‘কিন্তু উনি তো তেমন আসেন না এখানে যতদূর জানি।’

স্যার নিজের এলাকায় অনেক কম আসেন। হয়তো কয়েক বছর পর পর একবার আসেন। স্যার ঢাকায় কিছুটা বিখ্যাত জানতাম, বিশেষ করে যাঁরা দেশের সাহিত্য, রাজনীতি এইসব বিষয়ে পড়ালেখা করেন তাঁদের কাছে পরিচিত। কিন্তু নিজের এলাকায় যে এত পরিচিত হবেন আমি ভাবিনি। আর একজন রিক্সাওয়ালাও যেখানে তাঁকে চিনবে সেটা আমার কল্পনার বাইরে ছিলো।

আমরা বাজার থেকে জিনিশপত্র কিনে ফিরলাম নৌকায়। রাতে খাওয়া হলো মাছ-ভাত দিয়ে। ঘুমের আয়োজন তাবুতে। জেটির উপরে তাবু ঠিক করা হলো। তাবুর ভিতরে সঙ্গী আমরা আগের তিনজনেই, আমি রাহাত ভাই আর রিমন ভাই।

প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
শেষ পর্ব

Comments

comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.