স্বপ্নপূরণ–নৌকায় ঢাকা থেকে সেন্টমার্টিন (শেষ পর্ব)

কক্সবাজার
কক্সবাজার

সপ্তম দিন
ভোর ছয়টার দিকে আমরা আমাদের যাত্রা শুরু করলাম। কক্সবাজারে যখন পৌঁছালাম তখন ঘড়িতে সকাল ৭ টা। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে তেমন লোকজন নেই অনেক সকাল বলেই হয়তো। তবে কিছু কিছু লোকজন আছেই, কক্সবাজার বীচ মনে হয় কখনোই খালি হয় না। যাঁরা আছেন তাঁরা ভোরের সমুদ্র দেখার জন্য এসেছেন। সকালের প্রথম আলোয় সমুদ্র দেখার আনন্দই আলাদা। আর যদি প্রথম সমুদ্র দেখার জন্য আনন্দের মাত্রা হবে অনেক বেশি। আমার কাছে সমুদ্র একেক সময় একেক রকম সুন্দর। সকালে এক রকম, দুপুরে এক রকম, বিকালে এক রকম, সন্ধ্যায় এক রকম আর রাতে হাজার হাজার তারার মাঝে আরো অন্য রকম।

আরো প্রায় এক ঘণ্টা চলার পর হিমছড়ি দেখতে পেলাম। এখানকার দৃশ্য খুবই সুন্দর, একদিকে পাহাড়, আরেক দিকে বিশাল সমুদ্র, পানি আর পানি কিছুই দেখা যায় না। এখানের সমুদ্রে অনেক ঢেউ, নৌকা অনেক দুলছে। টুটু ভাই ঘোষণা দিলেন, এই ঢেউয়ের মাঝে রান্না করা যাবে না। আজকে বনরুটি খেয়েই থাকতে হবে। তবে আশ্বাস দিলেন আমরা হয়তো আজকে সেন্টমার্টিনে পৌঁছে যাবো রাতে বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা হবে।

বাবু ভাই
বাবু ভাই

কি মনে করে, মুজিব ভাই টুটু ভাইকে কানেমুখে বললেন, ‘বাবু ভাইকে কেমন জানি অন্য রকম লাগছে। আমার মনে হচ্ছে উনি চুল কেঁটেছেন, আপনি কি একটু দেখবেন।’ বাবু ভাই মাথায় গামছা পেচিয়ে ক্যাপ পড়ে পসে ছিলেন। টুটু ভাই বাবু ভাইয়ের ক্যাপ এবং গামছা টান দিয়ে খুলে ফেললেন। আমরা সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। বাবু ভাইয়ের মাথা একদম ন্যাড়া। আমরা সারাদিন একসঙ্গে এই ছোট্ট নৌকায় আছি অথচ কেউই বুঝতে পারিনি। এতোদিন বাবু ভাইয়ের মাথায় লম্বা চুল ছিলো। আজকে একদম ন্যাড়া মাথা।

খোকন ভাই বললেন, এই ঘটনা গতকাল রাতের। উনারা মহেশখালী বাজারে গিয়েছিলেন। ইচ্ছা ছিলো খোকন ভাই সেলুনে সেভ করবেন। কি মনে করে বাবু ভাইও তাঁর মাথা সেভ করিয়ে নিয়েছেন। বাবু ভাইয়ের ক্যামেরায় মাথা ন্যাড়া করার ভিডিও করা হয়েছে।

শুরু হলো টেকনাফের সীমানা। এই দিকে দূরে পাহাড় দেখা যাচ্ছে। পেছন থেকে খোকন ভাই ঢাকাইয়া ভাষায় বলে উঠলেন, ‘পাহাড় থেকে সমুদ্র দেখছি, আজকে সমুদ্র থেকে পাহাড় দেখলাম। জীবন সার্থক, এই ভ্রমণও সার্থক।’ এই দিকে পর্যটক নাই। যা দেখা যায় সবই জেলেদের কাজকর্ম। জেলেরা জাল শুকাচ্ছেন, কেউ জাল মেরামত করছেন। কেউ নৌকা মেরামত করছেন। আরো প্রায় তিন ঘণ্টা চলার পর টেকনাফের শেষ মাথায় চলে আসলাম। এখান থেকেই শাহপরীর দ্বীপ দেখা যাচ্ছিলো। শাহপরীর দ্বীপের কাছে আসার সঙ্গে সঙ্গে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেলো। আমরা চেয়েছিলাম শাহপরীর দ্বীপে আমাদের মাঝিকে নামিয়ে দিয়ে আমরা সেন্টমার্টিনে চলে যাবো। হাতে অনেক সময় ছিলো, ঘড়িতে চারটা বেজে ত্রিশ মিনিট। কিন্তু তীরে এসে তরী ডুবার মতোই অবস্থা। সমুদ্রের মাঝখানে হলে আমাদের বড় ধরনের বিপদে পরতে হতো।

টেকনাফ
টেকনাফ

আমাদের আরেকটা রাত এখানেই থাকতে হবে। রিমন ভাই আর দ্বীন ইসলাম চলে গেলেন মিস্ত্রি আনার জন্য। টুটু ভাই আর আনোয়ার ভাই চলে গেলেন বাজারে। মুজিব ভাই তাঁর কোস্ট গার্ডে থাকা তাঁর পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। কোস্ট গার্ডের ঘাঁটি শাহপরীর দ্বীপেই। সঙ্গে আমি আর রাহাত ভাই, উনাদের ওখান থেকে খাবার পানি আনার জন্য।

কোস্ট গার্ড সম্পর্কে কিছু অজানা তথ্য জানতে পারলাম। যেমন, আমাদের কোস্ট গার্ড মিয়ানমারের কোস্ট গার্ডের চাইতে অনেক শক্তিশালী। যেমন মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রে যুদ্ধ লাগলে তারা আমাদের সঙ্গে এক ঘণ্টাও টিকতে পারবে না। কারণ ওদের চাইতে আমাদের অস্ত্র অনেক উন্নত। পাশাপাশি ভারতের কোস্ট গার্ডের কথাও আসলো। ভারতের দিকে উল্টা, ভারতের সাথে সমুদ্রে যুদ্ধ লাগলে আমরা এক ঘণ্টাও টিকতে পারবো না। কারণ আমাদের চাইতে ভারতে অস্ত্র অনেক উন্নত। কোস্ট গার্ডে যাঁরা নিয়োগ পান তাঁরা সবাই বিভিন্ন বাহিনী থেকে আসেন। যেমন, র‌্যাব, পুলিশ, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এইসব বাহিনী থেকে লোকজন এনে কোস্ট গার্ড তৈরি করা হয়। অর্থাৎ প্রতি বাহিনী থেকেই কোস্ট গার্ডে লোক দিতে হয় একটা সময়ের জন্য। সেই কারণে কারো কারো ছয় মাস থাকতে হয়, কারো কারো একবছরও থাকতে হয়।

4247_1130171344371_6478033_nরাতে খানাদানা হলো দুর্দান্ত, টুটু ভাই তাঁর কথা রেখেছেন। বাজার থেকে মুরগী আনা হয়েছে। খাওয়া-দাওয়ার পর দেখা গেলো সমুদ্রের ঢেউ বেড়েছে। নৌকায় কোনোভাবেই থাকা যাবে না। নৌকাটাকে বাবু ভাইয়ের দড়ি দিয়ে ভালোমতো বাঁধা হলো। ঠিক হলো জেটিতেই থাকবো। জেটিতে আমি, রাহাত ভাই, রিমন ভাই মিলে তাবু পেতে দিলাম। এই কয়দিনে নৌকায় থাকতে থাকতে মাটিতে নামলেও মনে হয়ে মাটিও দুলছে। মনে হচ্ছিলো জেটিও নৌকার মতো দুলছে, রিমন ভাইকে রসিকতা করে বললাম, ‘রিমন ভাই নৌকার মতো তো জেটিও দুলে কেন?’ রিমন ভাইও বললো, ‘বুঝতে পারছি না।’ রাতের ঘুমটা ভালোই হলো। মাঝে মাঝে খোকন ভাইয়ের নাক ডাকা শুনতে পেলাম।

অষ্টম দিন
সকালে ঘুম থেকে উঠলাম ৯ টার দিকে। ঘুম থেকে উঠে নাস্তা শেষ করে অপেক্ষা করতে লাগলাম জোয়ারের জন্য। সকাল ১১ টার দিকে আমাদের যাত্রা শুরু হলো শেষ দিনের জন্য। বাম পাশে মায়ানমার রেখে সেন্টমার্টিনের উদ্দেশে রওনা দিলাম। শেষ সময়ে নৌকার হাল ধরলেন মুজিব ভাই নিজেই। কারণ এই জায়গাটা মোটামুটি ভালোই চেনেন তিনি। আমাদের নৌকা থেকে কেয়ারীসিনবাদের যাওয়া দেখলাম। রিমন ভাইও পথ দেখালেন, কিছুক্ষণ পর পর বয়া দেখে আমরা আমরা বুঝতে পারছিলাম আমরা ঠিক পথেই এগুচ্ছি। দুপুর সাড়ে বারোটার দিকে আমরা পৌঁছালাম আমাদের গন্তব্য বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বিপ সেন্টমার্টিনে।

সেন্টমার্টিন
সেন্টমার্টিনে আমাদের নৌকা

সেন্টমার্টিন জেটিতে নৌকা বাঁধা হলো। জেটিতে থাকা লোকজন আমাদের দিকে অবাক হয়ে তাঁকিয়ে আছেন। প্রথমে টুটু ভাই জেটিতে নামলেন। মাঝি দ্বীন ইসলাম বলে উঠলেন, ‘কোন দেশ থাইক্কা কোন দেশে আইলাম।’

প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
চতুর্থ পর্ব

Comments

comments

Comments

  1. md.nizamul haque

    অপুর্ব

  2. জটিল! সবগুলো পর্ব পড়লাম খুঁজে খুঁজে। অনেক ভালো লাগলো। ভালো একটা আইডিয়াও পেলাম। অনেক ধন্যবাদ সুন্দর একটা লেখার জন্য!

    সবগুলো পর্বের নীচে প্রথম থেকে বাকি পর্বগুলোর একটা লিংক দিলে পড়তে সুবিধা হবে।

    1. লিংক দিয়ে দিচ্ছি ভাইয়া। 🙂

  3. Rabbi

    Excellent experience…good writing…but where are the pictures..i expected a lot more pics!!!…can you send me link please?? Thanks.

    1. dilip

      yes . i like all the idea . excellent

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.