প্রায় ১ বছরের মতো কিন্ডারগার্ডেনে পড়াশোনার পর ভর্তি পরীক্ষা দিলাম স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার আশায়। কিন্ডারগার্টেনে পড়াশোনার স্মৃতি একদমই মনে নেই। কিন্ডারগার্টেনে পড়তাম লিটল জুয়েল প্রি-ক্যাডেট নামে একটি স্কুলে। তারপর ভর্তি পরীক্ষা দিলাম নাখালপাড়া হোসেন আলী উচ্চ বিদ্যালয় নামের স্কুলে। বড় ভাইয়ের হাত ধরে প্রথম স্কুলে গেলাম পরীক্ষা দেওয়ার জন্য। পরীক্ষা দিলাম, সহজে পাশও করলাম। রোল নাম্বার হলো ১৫।
প্রথমদিনের স্কুল ছিল অনেক আনন্দের। এতগুলো সমবয়সী ছেলে এক সাথে এর আগে আমি দেখেনি। ক্লাসে ঢুকে যে আগে সামনের বেঞ্চ দখল করতে পারবে তাকে সবাই আলাদা চোখে দেখে। কারণ স্যার এর সামনে বসতে পারে। কেউ কেউ চেষ্টা করতো তার কাছের বন্ধুটির জন্য পাসেই জায়গা রাখতে। এর মধ্যে আবার পেছনের দিকে একটা বেঞ্চ ছিল আলাদা, সেই বেঞ্চে ৪/৫ জন ছেলে আলাদা বসতো সব সময়। ওদের সঙ্গে সাধারণত কেউ বসতো না। কারণ ওরা হিন্দু। হিন্দু মানেই একটু ঘৃণা করতে হবে, এটা আমাদের পরিবার থেকে শিখিয়ে দেয়া হয়েছে। ওই সময় আমি নিজেও ঘৃণা করতাম। বাসা থেকে নানা কথাবার্তা বলে আম্মা বিশেষ কোর্স করিয়ে দিয়েছেন, হিন্দু সম্প্রদায়কে ঘৃণা করার জন্য। হিন্দুরা কখনো বেহেস্তে যাবে না, তারা সবাই বিনা হিসাবে জাহান্নামবাসী হবে, এই ধরনের কথাবার্তা।
এর প্রায় ১০/১২ বছর পর আমি স্কুল ছেড়ে দিয়েছি বিভিন্ন সমস্যার কারণে। পাশের বাসায় একটি ছোট্ট মেয়ে, নাম প্রজ্ঞা পারমিতা। পড়ে থ্রি অথবা ফোরে। ওর কাছেও শুনলাম একই ঘটনা। তবে তখন আমি অনেক বড় হয়েছি; বুঝতে শিখেছি। ওর কথা শুনে খুবই খারাপ লাগলো। ওর ২/৩ জনের বেশি বন্ধু নেই স্কুলে, কারণ ও হিন্দু। ওদের ব্যাঞ্চ আলাদা করা। ওদের বেঞ্চে কেউ বসে না। ওদের সঙ্গে দরকার ছাড়া কেউ কথা বলে না। এক সময় আমিও ওর বন্ধুদের মতো এই ধরনের আচরণ করেছি। যতদিন আমরা ওদের পাশের বাসায় ছিলাম প্রায় প্রতিদিনই মেয়েটি আমার সঙ্গে দেখা করতে আসতো; কথা-বার্তা বলতো। আমার সঙ্গে খুব ভালো বন্ধুত্বও হয়ে গিয়েছিল।
এখন পারমিতা কোথায় আছে কে জানে? নাখালপাড়া গেলে খুঁজলে হয়তো পাওয়া যাবে। কিন্তু সে এখন নিশ্চয়ই অনেক বড় হয়েছে। ওর কথা শুনে আমি যতটা কষ্ট পেয়েছিলাম, আমার চাইতে নিশ্চয় ও অনেক বেশি কষ্ট পেত আমাদের মতো মুসলমানদের কারণে।