
ছবি: ইন্টারনেট
তাঁকে প্রথম যখন দেখেছিলাম তখন আমার বয়স অনেক কম, স্কুলে পড়ি। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পাশ দিয়ে একটি রাস্তা নাখালপাড়া ঢুকে গেছে। সেই রাস্তার মোড়টাকে সবাই ড্রামফেক্টরি বলে। তিনি নিচের দিকে তাকিয়ে হেঁটে যেতেন। তাঁর ভক্তরা পেছন পেছন নানারকম খাবার-দাবার নিয়ে হাঁটতেন। আমরা সবাই তাঁকে পাগল বলতাম। তাঁর ভক্ত যারা পিছন পিছন হাঁটতেন তাদের ছাগল ছাড়া আর কিই বা বলতে পারতাম! কিছু ভক্ত আবার গাড়ি নিয়েও আসতেন। তিনি যেহেতু হাঁটতেন আর আমি তখন হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসের চরিত্র হিমুর মহা ভক্ত তাই তাঁকে কিছুটা সমীহও করতাম।
তাঁর সঙ্গে নতুনভাবে পরিচয় হয় শিশির ভাইয়ের মাধ্যমে লালমাটিয়ায়। পরিচয় বলতে তাঁর নাম জানতে পারলাম, কোথায় থাকেন তাও জানতে পারলাম। নাম হায়দার, থাকেন মোহাম্মদপুরে। শিশির ভাই মনে হয় হাঁটা বাবার আস্তানায় কয়েকবার খাওয়াদাওয়াও করেছিলেন।
আমি তাঁকে যতবার দেখেছি ততবারই তিনি হাঁটার মধ্যেই ছিলেন। একবার রাস্তা পার হওয়ার সময় চোখাচোখি হয়েছিল, ঠোটে অন্যরকম এক স্মিত হাসির রেশ ছিল। তিনি সাধারণত সামনের দিকে তাকাতেন না নিচের দিকে তাকিয়েই হাঁটতেন। তাঁর ভক্তরা সবাই তাঁকে পীর-ফকির হিসেবেই কল্পনা করতেন। কিন্তু তিনি এইসবের কিছুরই ধার ধারতেন না। লোকজন বলাবলি করতো বাবা যদি কারও দিকে একবার তাকান তা হলে তাঁর জীবনের সকল সমস্যা দূর হয়ে যায়।

ছবি: ইন্টারনেট
তিনি যে এই সবের কিছুরই ধার ধারতেন না তার এক বড় প্রমান পেলাম আলম ভাইয়ের মাধ্যমে। আলম ভাইও অনেকদিন যাবৎ মোহাম্মদপুরেই থাকেন। কোন এক বছরে হাঁটা বাবার ভক্তরা একটি ওরসের আয়োজন করলেন। যেদিন ওরস, ঠিক সেই দিনই তিনি হেঁটে টঙ্গীর দিকে চলে গেলেন। এইদিকে তাঁর ভক্তদের ওরস মাটি হয়ে গেলো।
হাঁটার মধ্যে যে কি সুখ আছে সেটা উনি হয়তো ভালই বুঝতে পেরেছিলেন। আর কোথাও না তাকিয়ে রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে যাওয়া এক ধরনের নেশার মত মনে হয়। যাঁরা নিয়মিত কোন ধরনের উদ্দেশ্য ছাড়া হাঁটতে পারে তাঁরা হয়তো এই আনন্দটা অনুভব করতে পারবেন। অন্য কেউ এর মর্ম বুঝতে পারবেন কিনা আমার সন্দেহ আছে। আমি নিজেও যখন এক জায়গায় থেকে আরেক জায়গায় যাই তখন মনে মনে অনেক কিছু করে ফেলি। একটা গল্প তৈরি করে ফেলতে পারি। আবার সেই গল্প ভেঙ্গে চুড়মার করে ফেলি।
আকাশপাতাল চিন্তা করতে করতে রাস্তা দিয়ে যখন হেঁটে যাই, কেউ ডাকলেও কানে কোন শব্দ ঢুকে না। ফোন দিলেও শব্দ শুনতে পাইনা। এ এক অদ্ভূত অনুভূতি। এই অনুভূতির কিছুটা হয়তো ইশতিয়াক ভাই অথবা ইমরান ভাই বুঝলেও বুঝতে পারবেন।
হায়দার সাহেবের মধ্যে আরেকটা জিনিশ বেশ লক্ষ্য করার মতো ছিল সেটা হল তাঁর ব্যক্তিত্ববোধ। তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা কোন কথা না বলে থাকতে পারতেন তাঁর আশেপাসে শতশত ভক্তদের মধ্যেও।
হাঁটা বাবা আপনার মতো যদি আমি হতে পারতাম তা হলে ভাল হতো, পৃথিবীর কোন কিছু আমাকে স্পর্শ করতে পারতো না।
বিদায় হায়দার সাহেব ওরফে হাঁটা বাবা। আর কোন দিন দেখা হবে না!
১৩.০৩.২০১৪