সৃষ্টিকর্তা আমাকে অদ্ভূত একটা ক্ষমতা দিয়েছেন। আমি কান্না গিলে ফেলতে পারি। আমি না বললে সাধারণত আমার মন খারাপ কেউ ধরতে পারে না। আমার খুব সহজে মন খারাপ হয়ও না। সবকিছু খুব সহজে গ্রহণ করে ফেলতে পারি। কেউ মারা গেলে অথবা খারাপ কিছু হলে সহজে বলে দিতে পারি, ‘ও আচ্ছা।’ এইটাকে দোষ বলি আর গুণ বলি কিছুটা পেয়েছি সম্ভবত আব্বার কাছ থেকে আর বাকিটা অভিজ্ঞতা থেকে।
আমার বয়স যখন খুব অল্প তখন আমার ইমিডিয়েট বড় ভাই মারা যান। সেটা ছিল আমার দেখা প্রথম মৃত্যু। তখন বাবাকে দেখলাম একদম কান্নাকাটি করে নাই। খুবই স্বাভাবিক। আমিও আমার সকল স্বাভাবিক কাজ সবসময় করে যাই, কোনদিন স্বাভাবিক কাজে হ্যাম্পার হতে দেই না। বড় ভাইয়ের মতো আমার এক বছরের ছোট ভাইকেও কবরে নামাতে হয়েছিল। তার আগে এই খবরটাও বাবাকে আমার দিতে হয়েছিল। বাবাকে ফোন দিয়ে প্রথমে কিছু বলি নাই। শুধু বলেছি রেডি হয়ে থাক আমি আসতেছি, আমার সঙ্গে যেতে হবে। বাবাকে সিএনজিতে বসে খবরটা দিয়েছিলাম, তখনও বাবা নির্বাক। শুধু আমার বাম হাতটা শক্ত করে ধরে রেখেছেন।
সত্যি কথা বলতে আমারও মন খারাপ হয়। কিন্তু যে কোন মন খারাপের মধ্যে আমি আনন্দ খুঁজে পাই। আমি সাধারণ খুব বেশি প্রয়োজন না হলে বিয়ে অথবা জন্মদিনে যাই না। আমার কাছে কেন জানি ভাল লাগে না। কিন্তু কেউ বিপদে পড়লে, সেখানে ছুটে যেতে খুবই ভাল লাগে। এইটা যে কেন হয় তা আমি জানি না।
আমার মা মারা গেছে আজ থেকে ঠিক ১৪ বছর আগে। মা মারা যাওয়ার সময় তাঁর ডান হাতটা আমি ধরে রেখেছিলাম, আর বাবার হাতে মায়ের বাম হাত ধরা ছিল। মা মারা যাওয়ার পরেও খুবই স্বাভাবিক আচরণ ছিল। গভীর রাতে মারা যাওয়ার কারণে পাশের বাসার শরীফ মামাদের বাসায় ভোর পর্যন্ত শুয়েছিলাম। ছোট ভাই পাসেই ছিল, সে একটু কান্নাকাটি করতেছিল। আমি ঝাড়ি দিয়ে বলেছিলাম, ‘কান্নাকাটির কিছু হয় নাই।’ দুপুরে কবর দিয়ে এসে খুব স্বাভাবিক ভাবে মুরগী দিয়ে ভাত খেয়েছি, কোন সমস্যা হয় নাই। বিকালের প্রচণ্ড কান্না পেয়েছিল, বন্ধু বাবুকে জড়িয়ে ধরে মনে হয় এক মিনিট কাঁদতে পেরেছিলাম। মা যখন মারা যায় ততদিনে আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু করে মাকে সহ তেরবার কবরে নেমে গিয়েছি। আমার বয়স যখন ১৯ তখন আমি ২৩ বার কাঁধে মৃত মানুষ তুলে ফেলেছি। এরপরে আর কখনো কতবার কবরে নেমেছি অথবা কাঁধে মৃত মানুষের খাটিয়া নিয়ে কবরের পথে গিয়েছি তার আর হিশাব রাখি নাই।
আজ ২৩ আগস্ট মার মৃত্যুর ১৪ বছর পরে এসে মাথায় প্রশ্নটা আসলো গত ১৪ বছরে ১৪ বার কাঁদছি বলে মনে হয় না। আমার কাছে সব সময়ই মনে হয়েছে, কষ্ট বিষয়টা ভাগাভাগি করার মতো বিষয় না। আবার সবার সঙ্গে এটা ভাগাভাগি করা যায়ও না। এটা নিজের কাছে থাকাই ভালো, অল্প কিছু মানুষের কাছে হয়তো শেয়ার করা যেতে পারে। কিন্তু আমার কাছে কেন জানি এইসব গিলে ফেলতেই ভাল লাগে।
.
.
৮ ভাদ্র ১৪২৫