২৩ ঘণ্টায় চট্টগ্রাম

ছবি: সৌরভ
ছবি: সৌরভ

সাইকেলে ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রাম যাওয়ার প্ল্যানটা সম্ভবত মনা ভাইয়ের মাথা থেকেই প্রথম বের হয়। এই কাজ করতে হলে কিছু অনুশীলনেরও দরকার। প্রথমে ঠিক হলো আমরা তিনজন যাব, সঙ্গে কেউ যেতে চাইলে যাবে। সেই তিন জন হলো, আমি মনা ভাই আর ছবির হাটে আড্ডা দেয় ছোট তুষার ভাই।

প্রেকটিসের জন্য প্রথমেই রুট ঠিক করা হলো শাহবাগ > মহাখালী > এয়ারপোর্ট > আব্দুল্লাহপুর > আশুলিয়া > মাজার রোড > মিরপুর দিয়ে শাহবাগ ফিরবো। একদিন বিকালে বেরও হয়ে গেলাম তিনজনে মিলে। তিনজনেরই রোড বাইক, আমার আর মনা ভাইয়ের সাইকেল একই রকম। তবে তুষার ভাইয়ের সাইকেলটা একটু অন্য রকম। অন্য রকম বলতে সাইকেলে মার্গাড বা কেরিয়ার নাই। তখনকার সময় কেরিয়ার-মার্গাড ছাড়া সাইকেল কল্পনাও করা যায় না। তার উপর তাঁর সাইকেলটা আমাদের সাইকেলের তুলনায় অনেক হালকা।

ছবি: সৌরভ
ছবি: সৌরভ

তুষার ভাইয়ের কাছে আরো জানতে পারলাম তিনি এই সাইকেল পুরনো কিনেছেন। বংশালে কোন সাইকেলের দোকানের পাশে ড্রেনের মধ্যে পড়ে ছিল। সেই সাইকেল তিনি ৪ হাজার টাকা দিয়ে কিনেছেন। আমি দাম শুনে তো অবাক! ৪ হাজার টাকায় পুরানো সাইকেল! তিনি সেই সাইকেল কেনার পরে ঠিক করাতে আরো কিছু টাকা খরচ করেছিলেন। অথচ এই টাকায় নতুন সাইকেলই পাওয়া যায়। সেই সাইকেলের বিশেষত্ব বুঝলাম যখন চালাতে নামলাম। আমাদের সাইকেলে তুলনায় তাঁর সাইকেলের পার্ফারমেন্স অনেক ভালো ছিল। আমার বেশ কষ্ট হয়েছিল সেই দিন। বার বার পিছিয়ে পড়ছিলাম। মনা ভাই সাহস দিয়ে বলেছিলেন কোন সমস্যা নাই। একটু প্রেকটিস করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি তো রেফরিংয়ের জন্য প্রতিদিন প্রেকটিস্ করি তাই আমার কষ্ট কম হয়েছে আর তুষারও তো নিয়মিত চালায়। আপনিও প্রতিদিন প্রেকটিস করেন ঠিক হয়ে যাবে।

সেই প্রেকটিসের পরে কেন জানি অনেক দিন আমদের আর এক সঙ্গে বের হওয়া হয়নি। তবে আমি প্রতি রাতেই অফিস শেষ করে ১/২ ঘণ্টার জন্য বের হয়ে যেতাম। বিভিন্ন ব্যস্ততার কারণে তুষার ভাই দল থেকে ছিটকে পড়লেন। কিন্তু আমি আর মনা ভাই প্ল্যান থেকে নরলাম না। আমাদের সঙ্গে নতুন করে যোগ দিলেন মুজাক্কের ভাই। আমরা তিন জন আবার আরেক দিন বের হলাম, আমাদের এবারের রুট ঢাকা থেকে মাওয়া। আশা-যাওয়া ৭০ কিলোমিটার। কোন ধরনের ঝামেলা ছাড়াই, এটাও করে ফেললাম। কিন্তু এবার আমার ছাড়া আর কারোই রোড বাইক নাই। মনা ভাইয়ের একটা মাউন্টেন বাইক আর মোজাক্কের ভাইয়ের হিরো রেঞ্জার ম্যাক্স। ঠিক হলো আমরা আমাদের এই সাইকেল নিয়েই যাব।

২০০৯ সালের ১৪ নবেম্বর তারিখের ফেসবুক স্টেটাস।
২০০৯ সালের ১৪ নবেম্বর তারিখের ফেসবুক স্টেটাস।

সময় হিসাবে বেছে নিলাম নভেম্বরের ১৪ তারিখ (২০০৯) বিকাল। যেহেতু বিকালে রওনা দেব তাই রাতেও চালাতে হবে। আবহাওয়া ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা থাকবে চালাতে কষ্ট কম হবে। রাত হওয়ার কারণে লাইটের ব্যবস্থাও করতে হবে। আল-আমিন ভাই আমাকে একটা লাইট বানিয়ে দিলেন, স্ক্রু দিয়ে সামনে হ্যান্ডেলবারেও লাগানোর ব্যবস্থা করে দিলেন। আর মুজাক্কের ভাইতো নিজেই ইঞ্জিনিয়ার তিনিও একটা লাইট বানিয়ে ফেললেন। সতর্কতার জন্য ঠিক করলাম ট্রাফিক পুলিশ যে রিফ্লেক্টর জ্যাকেট ব্যবহার করে, সেগুলো কিনবো। মনা ভাই খোঁজ দিলেন সেগুলো পলওয়ের মার্কেটে পাওয়া যায়। আমি যেয়ে পুলিশ লেখা ছাড়া জ্যাকেট খুঁজে বের করলাম। নিজের জন্য একটা কিনেও ফেললাম, জ্যাকেট দেখার পর মনা ভাইয়েরও পছন্দ হলো। কমলাপুর স্টেশনে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় ফেরার টিকেটও কেটে ফেললাম। আমাদের হিসাব ছিলো এমন, বিকাল পাঁচটায় রওনা দিলে, পরের দিন বিকাল পাঁচটার মধ্যে পৌঁছাবো। এবং রাতের ট্রেনেই ঢাকায় চলে আসবো।

যথারীতি চারুকলার সামনে থেকে রওনা দিলাম আমরা তিনজন। প্রথমেই পলওয়েল মার্কেট থেকে মনা ভাই রিফ্লেক্টর জ্যাকেট কিনলেন। তারপর তিনজনে রওনা দিলাম, তখনও সূর্যের আলো ছিলো। ঢাকার জ্যাম পাড়ি দিলাম গাড়ির চিপা-চাপা দিয়া। কাঁচপুরে যে কখন পৌঁছে গেলাম টেরই পেলাম না। শুরু হলো বিশ্বরোডের উপর দিয়ে চলা। ব্যাগ থেকে জ্যাকেট বের করে পরে নিলাম, যাতে দূর থেকে আলো পড়লে রিফ্লেক্ট করে। এক সময় সোনারগাঁ এর কাছে পৌঁছে গেলাম, একটা হোটেলে সামান্য নাস্তা করে নিলাম। তখনও আমরা সবাই সুস্থ এবং সবার স্পিড অনেক ভালো। স্পিড দেখে মনে হচ্ছিল পরের দিন দুপুর ১২টার মধ্যেই পৌঁছেই যাব। নিজেদের স্পিডে নিজেরাই অবাক!

দাউদকান্দি ব্রীজের কাছাকাছি আশার পরে একটা দুর্ঘটনা ঘটলো, মনা ভাইয়ের সাইকেলের প্যাডেল নড়বড়ে হয়ে গেলো। আমাদের কাছে যে ধরনের টুলস ছিলো, সেটা দিয়ে প্যাডেল টাইট দেওয়া যাচ্ছিল না। পাশে থাকা এক সিএনজি ড্রাইভারের কাছে প্যাডেল টাইট দেয়ার ডালি পেলাম, সেটা দিয়ে ভালো মতো টাইট দেয়া হলো। আবার চলতে শুরু করলাম, সম্ভবত রাত ১ টা ৩০ মিনিটের দিকে কুমিল্লা বিশ্বরোড পার হলাম। নাম না জানা এক জায়গায় রাতের খাওয়া শেষ করলাম পরাটা ভাজি আর ডিম দিয়ে। মনা ভাই ঠিক মতো কিছুই খেলেন না। কারণ তিনি অসুস্থ বোধ করছিলেন। মুজাক্কের ভাইয়ের কাছ থেকে জানতে পারলাম মনা ভাই গত রাতে একটুও ঘুমান নাই।

আমরা খাওয়ার পরে আবার চলতে শুরু করলাম রাত দুইটা কি আড়াইটার দিকে আমাদের একদল র‌্যাব থামালো। জিজ্ঞেস করলেন কে কি করি। আমরা এত রাতে এই রাস্তায় কেন? শুনে র‌্যাব তো আমাদের ধমক, ‘আপনারা কি পাগল নাকি! সাইকেল নিয়ে চট্টগ্রাম যাবেন? বাস নাই? বাসে যান। আর যদি এমন ইচ্ছা থাকেই দিনের বেলা যাবেন। রাতের বেলা কেন?’ ধমক দেয়ার পরে মনা ভাই নিজের পরিচয় দিলেন সাংবাদিক হিসেবে। সাংবাদিক বলাতে র‌্যাব ভাইরা কিছুটা শান্ত হলেন এবং খুব সাবধানে চালাতে বলে চলে গেলেন। আরো সতর্ক করে বলে দিলেন এই এলাকা যতদ্রুত সম্ভব পার হতে, এখানে নাকি ডাকাতি হয়।

ডাকাতের ভয়েই হয়তো আমরা একটু তাড়াতাড়িই এ জায়গা ত্যাগ করলাম। পাশ দিয়ে বড় বড় বাস-ট্রাকগুলো সাই সাই করে যাচ্ছিল। কেউ কাউকে পরোয়া করে। প্রতিটা বাস-ট্রাককে একেকটা আযরাইল মনে হচ্ছিল। চৌদ্দগ্রাম পার হওয়ার পর মনা ভাই আর একদমই পারছিলেন না। এক পাম্পের সামনে ফুতপাতে খোলা জায়গায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। আমি আর মুজাক্কের ভাই গল্প করছিলাম। প্রায় দেড়/দুই ঘণ্টা ঘুমানোর পর মনা ভাই উঠলেন। উঠে বললেন, ‘চলেন অনেক দেরি হয়ে গেছে। বুঝলেন শরীফ বয়স হয়ে গেছে বুঝা যাচ্ছে।’

ছবি: মুজাক্কের
ছবি: মুজাক্কের

আমরা আবার রওনা দিলাম। সাইকেল চালাতে চালাতে ভোর হওয়া দেখলাম কিভাবে আস্তে আস্তে অন্ধকার থেকে আলোতে রূপান্তরতি হয়। সকাল হওয়া যে এত সুন্দর আগে বুঝতে পারিনি। ফেনীর কাছাকাছি এসে রাস্তার পাশে একটা বিশাল পুকুর দেখে মনা ভাই শান্তির গোসল দিয়ে দিলেন। আমি আর মুজাক্কের ভাই ভালো মতো হাতমুখ ধুয়ে নিলাম। গোসলের পরে মনা ভাই বেশ সুস্থ হয়ে গেলেন। আমরা পুরাদমে সাইকেল চালাতে লাগলাম। এক দেড় ঘণ্টা পর পর কিছুটা বিরতী দিতে দিতে চলতে থাকলাম। ভাটিয়ারির কাছাকাছি পৌঁছানোর পর আমার বাম পায়ের রগে টান দিলো, চালাতে অনেক কষ্ট হচ্ছিল। বলা যায় অনেকটা এক পায়ে চালাচ্ছিলাম। যেখানেই থামতাত আমি শুয়ে পড়তাম মুজাক্কির ভাই কিছুটা ম্যাসেজ করে দিতেন। একসময় চট্টগ্রাম গেইটের কাছে পৌঁছে গেলাম, মোবাইলের ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি ৪ টা বাজতে তখনো ৫/৭ মিনিট বাকি আছে। অর্থাৎ আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছেছি এক ঘণ্টা আগেই। অসাধারণ লাগছিল, মনে হচ্ছিল অনেক বড় একটা কিছু জয় করে ফেলেছি।

সন্ধ্যার পরে চন্দন ভাই আসলেন আমাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য। সঙ্গে সৌরভ ভাই যাঁর সঙ্গে আগে কখনো পরিচয় হয় নাই তবে ফেসবুকে পরিচয় ছিলো, ঐ দিনই প্রথম দেখা হয়েছিল। এর আগে ফেসবুকে চ্যাট করার সময় একদিন তাঁকে বলে ছিলাম, ‘ভাই ঘুরতে ঘুরতে একদিন দেখা হয়ে যাবে।’ সৌরভ ভাই এখন সম্ভবত কাতার থাকেন। তাঁরা আমাদের রাতে খাইয়েছিলেন। ট্রেনে উঠার আগ পর্যন্ত অনেকক্ষণ আমরা একসঙ্গে আড্ডা দিয়েছিলাম চট্টগ্রাম স্টেশনে।

এই সাইকেল ভ্রমণটি ‘ভ্রমণ বাংলাদেশে’র ১০ প্রতিষ্ঠা বার্ষিকি উপলক্ষ্যে করেছিলাম সেই সময়ে।

* এই লেখাটি মনা ভাইয়ের অনুরোধে পুরোটাই স্মৃতি থেকে লেখা হয়েছে। অনেক কিছু বাদও পরে যেতে পারে।

Comments

comments