৬৪ জেলায় যা দেখেছি–১২

টাঙ্গাইলের পথে
টাঙ্গাইলের পথে

১২ মার্চ (গাজীপুর থেকে টাঙ্গাইল)

সকালে ঘুম থেকে উঠলাম অনেক দেরিতে, যখন সাইকেলে প্যাডেল দেই তখন ঘড়িতে ৯ বেজে ৩০ মিনিট। সাধারণত এত দেরিতে বের হইনা, বেশিরভাগ সময় ৭ টার আগেই বের হয়ে যেতাম। কিন্তু আজকে কেন একটু বেশিই ঘুমাতে হলো, ঘুম থেকে উঠতে পারিনি। গাজিপুর চৌরাস্তা পার হয়ে চান্দুনা পার হওয়ার পেলাম কোনাবাড়ি তারপর কাশিমপুর কারাগার। কাশিমপুর পার হওয়ার পরই দেখা গেল মৌচাকে বাংলাদেশ স্কাউট ক্যাম্প। ছোট বেলায় অনেক স্বপ্ন ছিলো স্কাউটিং করবো। কিন্তু কখনই করা হয় নি। তাই স্কাউটের ক্যাম্প দেখে মনটা কেমন জানি করে উঠলো।

শফিপুর বাজার, আনসার ভিডিপি একাডেমী, চন্দ্রা, বোর্ড বাজার তারপরই পেলাম মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ, সেখানে কিছুক্ষণ থামলাম মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ দেখার জন্য। ক্যাডেট কলেজ নামটা চোখে পড়লেই কেন জানি আর্মি অথবা পুলিশ পুলিশ একটা ভাব চলে আসে। এ ছাড়াও ক্যাডেট কলেজের উপর এক ধরনের কৌতূহল কাজ করে, ওদের কার্যক্রম কেমন? এই টাইপের প্রশ্ন।

টাঙ্গাইলের পথে
টাঙ্গাইলের পথে

এই ধরনের কথা চিন্তা করতে করতে যখন এগিয়ে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ করে মনে হল এক মটরসাইকেল আমাকে ফলো করছে। মোটর সাইকেলটি প্রতিবার আমাকে ওভারটেক করে সামনে চলে যায় এবং কোন দোকানে অথবা গাছের নিচে অপেক্ষা করে। আমি তাদের ক্রস করে চলে গেলে তারা আবার আমাকে ওভারটেক করে। আমি প্রথমে বুঝকে পারিনি কিন্তু কয়েকবার আমাকে ওভারটেক করার পর বুঝতে পারলাম তারা আমাকে ফলো করছে। আমি কিছুটা চিন্তিত এবং সামান্য ভয়ও লাগছিল। ভাবছিলাম হয়তো ছিন্তাইকারী হবে। আমার সঙ্গে দামি জিনিস বলতে একটা ক্যামেরা আর মোবাইল টাকা-পয়সাও বেশি নেই কারণ টাকা ব্যাংক থেকে অল্প অল্প করে তুলি।

এই ধরনের কথা চিন্তা করতে করতে একটি বড় সেতুতে উঠলাম, সেতু উঁচু হওয়ার কারণে স্বাভাবিকভাবেই সাইকেল ধীরে ধীরে চালাতে হচ্ছে। সেতুতে উঠার সঙ্গে সঙ্গে সেই মটর সাইকেল একদম পাশ দিয়ে সামনে গিয়ে থামল। আমাদের হাতের ইশারায় থামতে বললেন, মোটরসাইকেল আরোহী মোট দুইজন। কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। না থামা ছাড়া উপায়ও নেই। বাধ্য হয়েই থামতে হল, থামার পর যে মোটর সাইকেল চালাচ্ছিলেন তিনি প্রশ্ন করলেন, ইংরেজিতে, ‘হোয়ার আর ইউ ফ্রম?’ তাঁর প্রশ্ন শুনে আমার কাছে সব পরিষ্কার হয়ে গেল। তাঁরা ভেবেছেন আমি দেশের বাইরে থেকে এসেছি। আমি বাংলাতেই উত্তর দিলাম, ‘আমি আপনাদের মতই বাংলাদেশী।’ আমার মুখে বাংলা শুনে তাঁরা সামান্য আসাহত হলেন। তাঁদের আমার পেছনে পেছনে সময় দেয়াটাই নষ্ট হয়েছে বুঝতে পারলেন।

যিনি প্রশ্ন করেছিলেন তিনি আবার বললেন, ‘আমি ভেবেছিলাম আপনি শ্রীলঙ্কান অথবা ইন্ডিয়ান হবেন। তাই অনেক্ষণ যাবত আপনাকে ফলো করছিলাম সঙ্কোচের কারণে জিজ্ঞেস করতে পারছিলাম না। তবে আপনাকে দেখে ভাল লাগছে, আমাদের ছেলেরাও পারে অনেক করতে পারে!’ তাঁদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবার সামনের দিকে রওনা দিলাম।

পর্যায়ক্রমে গোড়াই, সোহাগপুর, কদিম ধল্যা, নাটিয়াপাড়া আরো কিছু ছোটবড় বাজার পার হয়ে বিকালের দিকে পৌঁছলাম টাঙ্গাইল শহরে। টাঙ্গাইলে পৌঁছেই ফোন দিলাম প্রথমেই ফোন দিলাম বাবু ভাইয়ের কাছে। বাবু ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল ঢাকায়, তাঁর বাড়ি টাঙ্গাল জেলার ভূয়াপুরের অর্জুনা গ্রামে। তিনি ঢাকা কলেজে পড়াশুনা করছেন। বাবু ভাই আগে থেকেই বলে রেখেছিলেন যেন টাঙ্গাইল আসলে তাঁকে ফোন করি। বাবু ভাইকে ফোন দেয়ার পর বাবু ভাই তাঁর এক স্যারের ফোন নাম্বার দিলেন, স্যারের নাম সোহেল সৌকর্য।

স্যার ভূয়াপুরের ইব্রাহী খাঁ সরকারী কলেজে শিক্ষকতা করেন। কিন্তু থাকেন টাঙ্গাইল শহরেই। স্যারকে ফোন দেয়ার পর তিনি লোকেসন বলে দিলেন কিভাবে যেতে হবে। তাঁর কথামতো খুঁজতে খুঁজতে পৌঁছে গেলাম বাসার কাছে, তিনি রাস্তাতেই আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। সাইকেল থেকে নেমে পেছন পেছন তাঁর বাসায় ঢুকলাম। আমাকে হাতমুখ ধোয়ার জন্য বাথরুম দেখিয়ে দিলেন। হাতমুখ ধোয়ার সময় শুনতে পেলাম তিনি ফোনে বাড়িতে কথা বলছেন। তাঁর কথাবার্তা শুনে বুঝতে পারলাম কিছুক্ষণ আগে তাঁর বাবা মারা গেছেন।

বিদিপ্ত
বিদিপ্ত

আমি কিছুক্ষণ বাথরুমে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। ইচ্ছা করেই বেশি সময় নিয়ে হাতমুখ ধুলাম। বের হয়ে এসে সোফায় বসলাম। চারিদিকে বইয়ের ছাড়ছড়ি, তবে সবই গোছানো। স্যারের ছোট্ট ছেলেটি আমার পাশে এসে বসলো। নাম জিজ্ঞেস করলাম, নাম বলল বিদিপ্ত। বিদিপ্ত, বিন্দু বাসিনী বালক বিদ্যালয়ে পড়ে। কোন শ্রেণিতে পড়ে জিজ্ঞেস করিনি প্রথম অথবা দ্বিতীয় শ্রেণিতে হবে। সে তার ছোট্ট সাইকেলটি আমাকে দেখাচ্ছিল। বিদিপ্ত বেশ আনন্দের সঙ্গে বলছিল, ‘আমার দাদু মারা গেছে আমরা এখন বাড়ি যাব।’ বাচ্চাটি মারা যাওয়া কি জানে না। কিন্তু দাদু বাড়িতে যেতে পারছে এটাই বড়, এটা বেশ আনন্দেরও।

হঠাৎ করে আমি অনেক দিন পেছনে চলে গিয়েছিলাম, বিদিপ্তর বয়সেই আমার এক বড় ভাই মারা গিয়েছিল গ্রামের বাড়িতে। তখনও আমি মারা যাওয়া কি বুঝতাম না। শুধু দেখেছিলাম বড় বোন, চাচী, চাচাতো ভাই বোনেরা চিৎকার করে কাঁদছে। আমারও কেন জানি মনে হল আমারও কাঁদতে হবে। সবাই কাঁদছে তাই আমিও অনেক কাঁদলাম। এক ফুফুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, মারা গেলে কি হয়? ফুফু উত্তর দিয়েছিলেন, মারা গেলে সবাই আকাশের ‘তারা’ হয়ে যায়। আমার ছোট্ট মনকে বুঝানোর জন্য সেটা মনে হয় সহজ ছিল। এটা হয়তো সবাই বলে মানুষ মারা গেলে ‘তারা’ হয়ে যায়।

এই কথা চিন্তা করছিলাম এবং অন্যমনস্ক ছিলাম। সোহেল স্যারের ডাক শুনেই আবার বাস্তবে ফিরে আসলাম। স্যার আমাকে খাবার টেবিলে নিয়ে গেলেন। আমার জন্য আগে থেকেই খাবার রান্না করা ছিল। বাবু ভাই আমার কথা আগে থেকেই বলে রেখেছিলেন, তাই তাঁরা আমার খাবার ব্যবস্থা আগেই করে রেখেছিলেন। খেতে খেতে স্যার বললেন, ‘আপনি তো সবই শুনেছেন, আমাদের এখনই বাড়িতে যেতে হচ্ছে। আমি খুবই দুঃখিত।’ আমি সঙ্গে সঙ্গেই বললাম, ‘স্যার, দুঃখিত বলার কিছুই নেই।’ স্যারও সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘আপনে অনেক গুনি একজন মানুষের সঙ্গে কাজ করেন আমি জানি। সলিমুল্লাহ খান স্যারের লেখা আমি নিয়মিত পড়ি। আমি স্যারের একরকম ভক্তও বলতে পারেন। আপনি আসবেন সে কথা আমি এখানকার শিল্পকলা একাডেমীতে বলে রেখেছিলাম। ইচ্ছা ছিল আমাদের পাঠাগারটা আপনাকে দেখাব। অনেকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব। কিন্তু কিছুই করা হল না, আমাদের এক্ষুনি বের হতে হবে। বুঝতেই পারছেন।’ আমি উত্তর দিলাম, ‘আপনি এই নিয়ে মন খারাপ করবেন না, আমি আবার আসবো।’

সুমন ভাই, যাঁর বাসায় রাতে ছিলাম।
সুমন ভাই, যাঁর বাসায় রাতে ছিলাম।

তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়ে আসলাম, তাঁরাও আমার সঙ্গে সঙ্গেই বের হয়ে আসলেন। বের হয়ে বাবু ভাইকে ফোন দিয়ে সবকিছু খুলে বললাম। আমার ইচ্ছা ছিল হোটেলে উঠে যাওয়া, কিন্তু বাবু ভাই মানা করে দিলেন তিনি আরেকটি নাম্বার দিলেন। এই নাম্বারটি তাঁর এক ছোট ভাই সুমন ভাইয়ের নাম্বার। সুমন ভাই টাঙ্গাইল শহরে থেকে পড়ালেখা করছেন। সুমন ভাইকে ফোন দিয়ে রওনা দিলাম আমার নতুন গন্তব্যে। সুমন ভাইয়ের বাসা পেতে তেমন সময় লাগলো না। ভাইয়ার বাসায় পৌঁছে জিনিসপত্র রেখে একা একা বের হয়ে আসলাম শহরটা দেখার জন্য। সুমন ভাই তেমন সময় দিতে পারলেন না, কারণ সামনে তার পরীক্ষা।

শহরের বেশির ভাগ দোকানই বন্ধ কেমন যেন ভুতুরে ভুতুরে পরিবেশ। মন খারাপ করা মন নিয়ে এলোমেলো ভাবে প্রায় দুই ঘণ্টা হাঁটাহাঁটি করলাম। এক মিষ্টির দোকান একবার ইচ্ছা হলো চমচম খেয়ে যাই কিন্তু কেন জানি দোকানে ঢুকতে ইচ্ছা করলো না। বাসায় ফিরে আসলাম, রাতের খাওয়া শেষ করে অনেকক্ষণ গল্প করে ঘুমোতে গেলাম।

মনে হল আমার ভ্রমণের সব চাইতে খারাপ একটি দিন পার করলাম। স্মৃষ্টি কর্তার কাছে প্রার্থনা করলাম এই দিন যেন আমার আর না আসে।

Comments

comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.