১৭ মার্চ (কুড়িগ্রাম থেকে লালমনিরহাট)
কুড়িগ্রাম থেকে কায়সার ভাই ও জাহাঙ্গীর ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হতে হতে সকাল দশটা বেজে গেল। এত দেরি সাধারণত হয় না। জাহাঙ্গীর ভাইয়ের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে ঠিক করেছিলাম হাতিবান্দার দিকে রাত কাটাবো। সেখানে ডাকবাংলো আছে, যদি ডাকবাংলো নাও পাই জাহাঙ্গীর ভাই থাকার ব্যবস্থা করবেন। উনার বাড়ি হাতিবান্দাতেই। জাহাঙ্গীর ভাই কায়সার ভাইয়ের সহকর্মী তাঁরা এক সঙ্গেই কাজ করেন মানে শিক্ষকতা করেন।
পলিটেকনিক্যাল থেকে বের হওয়ার পর সাইকেল চালাতে কেন জানি কষ্ট হচ্ছিল। থেমে সাইকেলের সিটটা আরো একটু উঁচু করে নিলাম। এতে কিছুটা আরাম পেলাম। রাস্তায় নামার পর অনেক সাইক্লিং সঙ্গী পেলাম। বিশেষ করে শহরের দিকে। এখানেও একজনকে পেয়ে গেলাম। কাঠাল বাড়ি পার হয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক ছেলেকে পেলাম সে ত্রিমোহানি বাজার, রায়পুর বাজার হয়ে বড়বাড়ি পর্যন্ত আমাকে সঙ্গ দিল।
ছেলেটি অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। ছেলেটির আমার প্রতি ব্যপক আগ্রহ সারা রাস্তাজুড়ে নানা রকম প্রশ্ন। কথায় কথায় জানতে পারলাম সে কোচিংয়ে যাচ্ছে। কোচিং শেষে স্কুলে যাবে। ছেলেটির স্কুল এবং কোচিং বড়বাড়িতেই। বড়বাড়িতে এসে আমাদের দুইজনের রাস্তা দুই দিকে চলে গেল। আমি আমার রাস্তা অর্থাৎ লালমনির হাটের দিকে রওনা দিলাম।
কিছুদূর চালানোর পর চাকায় পাম্প কম মনে হচ্ছিল। পাশেই একটা দোকান পেলাম সেখানে পাম্প দিলাম। এক কিলোমিটার চালানোর পর দেখি আবার পাম্প নাই বুঝতে পারলাম লিক হয়েছে। এই টিউবে এর আগেও তিন-চারটা লিংক ছিল। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম এই টিউবটি ফেলে দিয়ে নতুন টিউব লাগাবো।
সাইকেলে আরেকটা সমস্যা ছিল। পাম্প দিলে টিউব এক দিক দিয়ে ফুলে থাকে। তাই আলামিন ভাইকে ফোন দিলাম। আলামিন ভাই ঢাকাতে থাকেন গত কয়েকবছর ধরে উনার কাছেই আমি সাইকেল ঠিকঠাক করিয়ে থাকি। এমনি ভ্রমণের আগে উনার কাছ থেকে সপ্তাহখানেক সাইকেল সারানোর কাজও শিখে এসেছি। আলামিনভাইকে ফোন দেয়াতে সবকিছু শুনে উনি জানালেন এটা আসলে টিউবের সমস্যা না যেটা আমি ভেবেছিলাম। উনি জানালেন এটা টায়ারের সমস্যা। টায়ারটা পাল্টে ফেলতে হবে। চিন্তা করলাম যেভাবে চলছে এভাবেই আজকের দিনটা পার করি। আগামীকাল নতুন টিউব দিয়ে নতুন দিন শুরু করবো। আজ শুধু টিউবটা পাল্টে ফেলবো।
অনেক রোধ ছিল তাই গাছের ছায়া খুঁজে বের করলাম। সেখানে আরাম করে বসলাম। সাইকেল থেকে পেনিয়ার নামালাম। তারপর আগের টিউব পাল্টে নতুন টিউবটা লাগালাম। আমি আগে কখনো একা একা টিউব লাগাই নাই। আমার প্রায় আধা ঘণ্টা সময় লাগলো টিউব লাগাতে। তবে এই উছিলায় মোটামুটি শিখে ফেললাম কিভাবে টিউব লাগাতে হয়।
নতুন টিউব লাগিয়ে অল্প কিছুদূর চালানোর পরেই ধ্রিম করে শব্দ করে টায়ার এবং টিউব বাস্ট হল। প্রথমে বিকট শব্দে ভয় পেয়েগিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম কোথাও বোমা ফুটলো, পরক্ষণেই পাশ দিয়ে এক ভ্যানওয়ালা যাচ্ছিল তিনি হেসে বললেন ভাই আপনার সাইকেলের টিউব বাস্ট হয়েছে। আর এই রাস্তাটা কুফা সবারই কেন জানি এখানে টায়ার টিউব বাস্ট হয়।
বুঝতে পারলাম না কেন এই ঘটনা ঘটেছে। আমার টিউব পুরনো হলেও টায়ার তো নতুন ছিল। চিন্তা করছিলাম কি করবো? টায়ার একটা অতিরিক্ত আছে কিন্তু টিউব তো নাই। আগেরটাও ফেলে দিয়েছি। আর বাস্ট হওয়া টিউব সাধারণত ব্যবহার করা যায় না। অনেক বড় ফাঁক হয়ে যায়। এটার ক্ষেত্রেও ব্যাতিক্রম হয় নাই। প্রায় তিন ইঞ্চির মত হবে ফাঁকা।
চিন্তা করলাম পুরানাটা তো ঠিক করা যাবে। নতুনটা দিয়ে কিছুই হবে না। আবার পিছনের দিকে হাঁটা দিলাম পুরানাটা টিউবটার জন্য। আগের জায়গাতেই পেয়ে গেলাম পুরানা টিউবটা। সেটা ঠিক করার জন্য বসলাম। ফুটা হয়েছে কোথায় সেটা দেখার জন্য পাম্প দিছিলাম হঠাৎ করে পুরানা টিউবটা ধ্রিম করে বাস্ট হলো। আমি হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম। বাস্ট হওয়ার সময় চারিদিকে ধুলা উড়তে থাকলো।
যেখানে টায়ার-টিউব বাস্ট হলো সেখান থেকে লালমনিরহাট প্রায় আট কিলোমিটারের মতো দূরত্ব। খুব বেশি না। আমার ইচ্ছা ছিল লালমনিরহাটে থাকবো না। আরো কিছুদূর এগিয়ে হাতিবান্দা থাকবো। কিন্তু আমার প্ল্যান পাল্টাতে হলো। ঠিক করলাম লালমনিরহাটেই আজ রাতে থাকবো। সেখানে নতুন টিউব কিনতে হবে। সাইকেল সারিয়ে আগামীকাল একবারে রওনা দিব। আর বাকি আট কিলোমিটার হেঁটেই রওনা দিব। প্রথমে ভেবেছিলাম ভ্যানে যাব কিন্তু কোন ভ্যান পেলাম না। তাই হাঁটারই সিদ্ধান্ত নিলাম।
পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকে জানি বড় শহর না হলে আমার সাইকেল অনুযায়ী টায়ার-টিউব পাওয়া যায় না। বিশেষ করে রোড বাইকের টায়ারটিউব পাওয়া খুবই কঠিন। তাই হাঁটতে হাঁটতে মনা ভাইকে ফোন দিলাম। সবকিছু খুলে বললাম। তিনি সব শুনে বললেন কোন কিছু চিন্তা না করতে তিনি রাতে কুরিয়ারে টায়ারটিউব পাঠিয়ে দিবেন। যদি একটু দেরি হয় তাহলে প্রয়োজনে লালমনিরহাট একদিন বেশি থাকবো।
কিছুদূর হাঁটার পরেই একটি বাজার পেলাম নাম বুড়িরহাট। এর পরেই একটি চার রাস্তার মোর সেখানে লোকজনকে জিজ্ঞেস করে পথের দিশা জেনে নিলাম। লোকজনদের দেখানো পথে অনেকদূর আগানোর পরেই চোখে পড়লো একটি ছোট এয়ারপোর্ট। একটা গেইটে লেখা দেখলাম লালমনিরহাট এয়ারপোর্ট। বিমান নামে কিনা প্রথমে আমার সন্দেহ হলো, তবে নামলেও ছোট ছোট বিমান নামে আমার ধারণা। কারণ রানওয়েটি খুবই ছোট। আর একটা সাইনবোর্ডে লেখা বিমান বাহিনীর এলাকা।
সামনে এগুতে থাকলাম। বিমান বাহিনীর চার-পাঁচনের সঙ্গে দেখা। তাঁরা আমাকে থামালেন। মনে হয় বেশভুশা দেখে কৌতূহল হয়েই থামিয়েছেন। আমার সম্বন্ধে আদ্যপাদ্য অনেককিছুই জিজ্ঞেস করলেন। কথাবার্তা শুনে তারা বেশ অবাক হলেন। তবে আমাকে শুভকামনা জানিয়েই বিদায় দিলেন।
হেঁটে হেঁটে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম, উল্টা পাশ থেকে রিক্সায় বসা দুইজন লোক আমাকে ডাকলেন। হেঁটে যাওয়ার কারণে অনেকের সঙ্গেই কথা বলতে হচ্ছিল। সাইকেলে গেলে হয়তো এত লোকজনের সঙ্গে কথা হইতো না। সবারই একই ধরনের প্রশ্ন কোত্থেকে আসছি কোথায় যাব? রিক্সায় বসা দুই ভদ্রলোকেরই একই প্রশ্ন আমারও একই উত্তর। তবে এখানে একটু অন্য রকম ঘটনা ঘটলো। দুইজনই আমার ছবি তুলতে চাইলেন। ছবি তুলার পরে প্রশ্ন করলেন আমার ফেসবুকে একাউন্ট আছে কিনা। একাউন্ট আইডি জানানোর পর তাঁরা জানালেন রিকুয়েস্ট পাঠাবেন আমি যেন এক্সেপ্ট করি। আরো কিছুক্ষণ কথা বলে বিদায় নিলেন তারা।
প্রায় দুই ঘণ্টা পরে লালমনিরহাট শহরে পৌঁছালাম। প্রথমেই চলে গেলাম এলজিইডির ডাকবাংলোতে। সেখানে যেয়ে থাকার কোন ব্যবস্থা করা গেল না। তাই বাধ্য হয়ে চলে গেলাম হোটেল খুঁজতে। রেললাইনের পাশেই একটি হোটেল খুঁজে পেলাম। সেখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে গোসল করে বের হলাম শহর দেখতে।
বিডিআর রোড, পুরানো বাস স্ট্যান্ড, স্টেশন হেঁটে হেঁটে ঘুরছিলাম। আর সাইকেলের দোকান খুঁজছিলাম। দুয়েকটা দোকান পেয়েছিলাম কিন্তু কোন দোকানেই আমার চাহিদামত টায়ারটিউব পেলাম না। হোটেলে ফিরবো এমন সময় মনা ভাইয়ের ফোন। তিনি জানালেন টায়ারটিউব কেনা হয়েছে কিন্তু পাঠানোর কোন সুযোগ পাচ্ছেন না। আমাকে হোটেলের ঠিকানা দিতে বললেন এখানে কুরিয়ার করে পাঠিয়ে দিবেন। কিন্তু সেটা একদিন পরে, ছুটির দিন থাকায় মোটামুটি সব কুরিয়ার বন্ধ। আমি তাঁকে ঠিকানা পাঠালাম। আর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম এখানে আরো অতিরিক্ত একদিন থাকার।
একটু পরেই আবু বকর ভাইয়ের ফোন। তিনি জানালেন একটা ব্যবস্থা হয়েছে। বংশালের রঞ্জু ভাই আমার সঙ্গে কথা বলবেন। রঞ্জু ভাই ফোন দিয়ে জানালেন লালমনিরহাটে উনার এক ব্যবাসায়িক বন্ধু আছেন রিক্সা-সাইকেলের জিনিশপত্র বিক্রি করেন। রঞ্জু ভাইয়ের দোকান থেকেই পাইকারী জিনিশপত্র কিনে থাকেন। উনি আশেপাশে সব দোকানে খোঁজ নিয়ে লালমনিরহাটেই টায়ারটিউব ব্যবস্থা করছেন।
রঞ্জু ভাই একটা ফোন নাম্বার দিলেন আর উনার নাম বললেন জাহাঙ্গীর। আমি জাহাঙ্গীর ভাইকে ফোন দিলাম। তিনি আমাকে কিভাবে উনার দোকানে যেতে হবে বলে দিলেন। আমার হোটেলের একটু কাছেই ছিল তাঁর দোকান। জাহাঙ্গীর ভাই জানালেন উনার দোকানে টায়ারটিউব নাই। এই এলাকায় এই ধরনের সাইকেল খুব একটা নাই তাই টায়ারটিউব পাওয়া একটু কঠিন।
তবে একজন মাস ছয়েক আগে এনেছিলেন কিন্তু বিক্রি হয় নাই এমন একজনকে পাওয়া গেছে তিনি নিজেই নিয়ে আসতেছেন। আমাকে একটু অপেক্ষা করতে বললেন। কিছুক্ষণ পরে একটি ছেলে দুটি টিউব আর একটা টায়ার দিয়ে গেলেন।
টায়ারটিউব নিয়ে টাকা দিতে গেলাম কিন্তু কোনভাবেই টাকা দিতে পারলাম না। জাহাঙ্গীর ভাইয়ের একটাই কথা আমাকে সহযোগিতা করতে পেরেই অনেক খুশি। আমি যে এত বড় একটা বিষয় নিয়ে বের হয়েছি তাতে একটু সহযোগিতা করতে পেরেছেন এতেই তিনি অনেক খুশি।
জাহাঙ্গীর ভাইকে ধন্যবাদ দিয়ে ফুরফুরে মন নিয়ে হোটেলে ফিরলাম। সাইকেলের টায়ারটিউব লাগিয়ে রাতের খাবার খেতে গেলাম। খাওয়ার পর বেশ ভাল একটা ঘুম দিলাম।
