৬৪ জেলায় যা দেখেছি–১৮

১৮ মার্চ (লালমনিরহাট থেকে তিস্তা ব্যারেজ)

লালমনিরহাট থেকে যখন রওনা দেই তখন ঘড়িতে ৮:৩০। উদ্দেশ্য নীলফামারী পৌঁছানো। স্থানীয় লোকজনের কথা মতো দূরত্ব প্রায় ১২৫ কিলোমিটার আর এখানে কোন মাইলস্টোনও চোখে পড়েনি যা দেখে বোঝা যাবে আসলেই কত কিলোমিটার! প্রায় ১০/১৫ কিলোমিটার চালানোর পর সাইকেলের ফ্রিবলে ঝামেলা শুরু হলো।

প্যাডেল ঘুরে কিন্তু সাইকেলের চাকা ঘুরে না, এভাবেই অনেক কষ্ট করে মোটামুটি নষ্ট সাইকেল নিয়েই চালিয়ে যেতে থাকলাম, অদিতমারী, নামুরী, পলাশবাড়ি পার হয়ে কালিগঞ্জ নামক একটি বাজারে এসে এক সাইকেলের মিস্ত্রী পেলাম। এর আগে কয়েকটা দোকানে দেখিয়েছিলাম কিন্তু ধরতে সাহস পেল না। তাঁর কাছ থেকে সাইকেল ঠিক করালাম প্রায় এক ঘণ্টা চেষ্টার পর। এখানকার মেকারদের বড় সমস্যা তাঁরা গিয়ারওয়ালা সাইকেল খুব একটা আগে দেখে নাই। তাই সাইকেল ঠিক করাতে বেশি সময় লাগলো। সাইকেল ঠিক করানোর পর আবার রওনা দিলাম। হাতিবান্দা, বড় খাতরা পার হয়ে কিছু দূর আশার পরেই রাস্তাটা দুই ভাগ হয়ে গেল। একটি চলে গেল পাটগ্রাম বা দহগ্রাম এবং ভারতের বর্ডারের দিকে অন্যটি তিস্তা ব্যারেজ হয়ে নীলফামারীর দিকে। রুট প্ল্যান অনুযায়ী আমি নীলফামারীর দিকে রওনা দিলাম।

হাতিবান্দা পার হয়ে আরো কিছুক্ষণ চালানোর পর পেলাম তিস্তা ব্যারেজ, জায়গার নাম ডালিয়া। তিস্তা ব্যারেজে যখন পৌঁছাই তখন প্রায় বিকাল হয়ে গেছে। হিশাব-নিকাশ করে দেখলাম এভাবে চলতে থাকলে সন্ধ্যার মধ্যে নীলফামারী শহরে পৌঁছানো যাবে না, পথে কোথাও রাত হয়ে যাবে। পথে সাইকেল ঠিক করাতে অনেক সময় চলে গেছে তাই এই বিড়ম্বনা।
তিস্তা ব্যারেজ
ঠিক করলাম তিস্তা ব্যারেজের আসে-পাশে থেকে যাব। থাকার জায়গা খুঁজতে শুরু করলাম। তিস্তা ব্যারেজের কয়েকজন কর্মচারী এবং পুলিশ পেলাম তাঁদের কাছে আমার সমস্যার কথা বললাম। তাঁরা যখন জানতে পারলো আমি সাইকেলে বাংলাদেশ ভ্রমণে বের হয়েছি আমার সমস্যা সমাধানের আগে নিজেরা আমার সঙ্গে ছবি তোলার প্রতিই বেশি আগ্রহী। আমিও সময় দিলাম তাঁদের ছবি তুলতে। পুলিশ আর কর্মকর্তাদের ছবি তোলা দেখে স্থানীয় কিছু ছেলেপেলেও জুটে গেল ছবি তোলার জন্য।

ছবি তোলা শেষে অবশ্য তাঁরা আমাকে কিছুটা সহযোগিতা করেছিলেন ঠিকই। আমাকে পরামর্শ দিলেন এখানে একটি ডাক-বাংলো আছে। ইঞ্জিনিয়ারের কাছে অনুমুতি নিয়ে থাকা যেতে পারে। তাই রওনা দিলাম ইঞ্জিনিয়ারের খোঁজে। ডাকবাংলোতে পেলাম দায়িত্বে থাকা একজন আনসারেকে তিনি আমাকে জানালেন ইঞ্জিনিয়ার সাহেব সাইডে আছেন, তাঁর আসতে আসতে সন্ধ্যা হবে। আমি যদি অপেক্ষা করি তাহলে ইঞ্জিনিয়ার আসলে অনুমতি সাপেক্ষে থাকা যেতে পারে। আর বাংলোর চাবিও তাঁর কাছে।
34942_1493811555149_6222085_n
সিদ্ধান্ত নিলাম ইঞ্জিনিয়ার সাহেব না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করবো। এই ফাঁকে আসে-পাশে ঘুরতে বের হয়ে গেলাম বেশ সাজানোগোছানো জায়গা। বাধ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে এই ব্যারেজ। আশে-পাশে বেশ সুন্দর বাগান তৈরি করে রাখা হয়েছে। সুন্দর জায়গায় একটি সুন্দর সন্ধ্যা কাটলো। সন্ধ্যায় যখন বাংলোতে ফিরলাম তখন আনসার জানালেন ইঞ্জিনিয়ার সাহেব সাইট থেকে রংপুর চলে গেছেন তিনি আর আজকে রাতে আসবেন না। বেশ সমস্যায় পড়ে গেলাম কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। তখন আনসার সদস্য বললেন, ‘আপনি রাতের খাবার খেয়ে আসেন দেখি আমি কোন ব্যবস্থা করতে পারি কিনা আপনার জন্য।’

পাশেই বাজার বাজারের নামটাও বেশ সাধুর বাজার। খাওয়া শেষে ফিরে দেখি তাঁরা নিজেরা যে রুমটিতে বিশ্রাম নেন সেই রুমেই আমার জন্য বিছানাবালিশ আর মশারী টানিয়ে আমার থাকার ব্যবস্থা করে রেখেছেন। সঙ্গে অনেক বিনয়ের সঙ্গে বলছেন, ‘ভাই আমাদের জন্য আপনে একটা সমস্যায় পড়েছেন, তাই বাড়ি থেকে বিছানাবালিশ আর মশারি নিয়ে আসছি। আপনার থাকতে একটু কষ্ট হবে, আমাদের ক্ষমা করবেন।’

উনারা দুইজন ছিলেন। একজন পাহারা দেন আরেকজন ঘুমান। নিচে বিছানা করেছেন। পাশে একটা সোফাও আছে। আমি সোফাতেই শুয়ে পড়লাম। একটা রাতেরই ব্যপার দেখতে দেখতে চলে যাবে। উনারা মশার কয়েল জ্বালিয়ে দিলেন। আমার সঙ্গে অডোমোস ছিল সেটা মেখে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।

অনেক রাতে সেই ইঞ্জিনিয়ার আসলেন। আনসার সদস্য আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুললেন। তখন ভোর হতে বেশি দেরি নাই। আমার নাম-ঠিকানা উদ্দেশ্য জেনে দায়িত্বে থাকা ইঞ্জিনিয়ার আমার জন্য একটি রুম খুলে দিতে চাইলেন। আমি না করে দিলাম মাত্র দুই ঘণ্টা পরেই আলো ফুটবে। শুধু শুধু দুই ঘণ্টার জন্য তাঁদের আর কষ্ট দিতে চাইনি। খুব ভোরেই আনসার সদস্য আর ঐ ইঞ্জিনিয়ারকে ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় নিলাম নীলফামারীর উদ্দেশে।

আনসার সদস্যদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই। এই গল্প হয়তো আমি সারাজীবন সবার সঙ্গে করবো।

Comments

comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.