২০ মার্চ (নীলফামারি থেকে পঞ্চগড়)
রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমানোর কারণে তাড়াতাড়িই ঘুম ভেঙ্গে গেল। আগের রাতেই হোটেলের দায়িত্বে থাকা ছেলেটাকে বলেছিলাম আমি খুব ভোরে বের হয়ে যাব। সে সকালে গেইট খুলেই রেখেছিল। পথে নেমে ফিরতি পথ ধরলাম। গতকাল যে রাস্তা দিয়ে এসেছি সেই রাস্তা দিয়েই পলাশ বাড়ি, ডোমার পর্যন্ত যেতে হবে, পথের দূরত্ব প্রায় একুশ কিলোমিটার। তারপর অন্য রাস্তা ধরতে হবে।
ডোমার রেলগেট পার হয়ে একটি রাস্তা দেবীগঞ্জের দিকে গেছে। আমি সেই রাস্তা ধরলাম। পঞ্চগড় যাওয়ার জন্য ম্যাপে একটা রাস্তা দেখেছিলাম যেই রাস্তাটা মূল রাস্তা এড়িয়ে অন্য একটা রাস্তা গেছে। ঐ রাস্তা দিয়ে গেলে গাড়ি অনেক কম থাকবে কিন্তু রাস্তা একটু সরু হবে। সরু রাস্তা আমার জন্য সমস্যা না। অতিরিক্ত গাড়ির চাপ থাকলে বরং একটু বিরক্ত লাগে।

সাইকেল চালিয়ে এক সময় দেবীগঞ্জ পৌঁছালাম। সেখানে একজনের সঙ্গে কথা বলে ম্যাপের রাস্তাটা কোন দিকে সেটা জেনে নিলাম। সেই লোক আমাকে বেশ ভাল তথ্য দিলেন। রাস্তাটা মারোয়া নামক একটা বাজার হয়ে বের হয়েছে। তিনি আরো বললেন রাস্তা অবস্থা ভাল তবে এক কিলোমিটারের মত কাঁচা রাস্তা থাকবে। সেটা আমার সাইকেলের জন্য অসুবিধা হবে না। বরং আমার জন্য ভালই হবে। এই রাস্তায় গাড়ি একদমই পাওয়া যাবে না। শুধু দুয়েকটা রিক্সা অথবা ভ্যান হয়তো দেখা যেতে পারে। আর রাস্তা চিনতেও আমার খুব একটা সমস্যা হবে না, একটাই রাস্তা। শুধু মারোয়ায় যেয়ে কাউকে জিজ্ঞেস করে পরবর্তী ডেসটিনেশন জেনে নিতে হবে।
তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সামনে এগুতে থাকলাম। পথে করতোয়া নদীর উপর দিয়ে যেতে হলো। সেতুটি একটু বড়ই বলতে হবে। সেতু দিয়ে আরেকজন সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁর কাছে জানতে চাইলাম আমার কাঙ্খিত রাস্তার হদিশ। তিনি আমাকে একটা ভাল খবর দিলেন তিনিও অনেক দূর ঐ পথেই যাবেন। তাই আমিও তার সঙ্গী হলাম বা বলা যায় তিনিও আমার সাথে কিছু পথের সঙ্গী হলেন। আমিও খুশি হলাম একা চালানোর চাইতে কথা বলার জন্য একজনকে পাওয়া গেল।
কথা বলতে বলতে আমরা এগুচ্ছি। করতোয়া সেতু পার হয়ে আরো একটু ছোট সেতু পেলাম। যেটির কাজ চলছে তাই ঐ সেতুর উপর যেতে হয় নাই। পাশ দিয়ে মাটি উঁচু করে রেখেছে সেখান দিয়ে পার হলাম। কিছুদূর এগুনোর পরেই আমার সঙ্গী সাইক্লিস্টের চেইন ছিড়ে গেল। তিনি আমাকে পথের দিশা বুঝিয়ে দিলেন। আর তিনি ঠিক করলেন কিছুদূর হেঁটে সামনে বাজার পেলে ঠিক করবেন। উনাকে বিপদে ফেলে আমার একা যেতে ইচ্ছা করলো না। আমিও উনার সঙ্গে হাঁটা দিলাম।
কিছুদূর যাওয়ার পরেই ছোট্ট একটা বাজার পেলাম। সেখানে আমার সঙ্গী থেমে গেলেন। উনার সাইকেলের চেইন জোড়া দিতে ভালই সময় লাগবে। তাই উনার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। উনার কথা মতো রাস্তায় অনেক এগুনোর পর একটা চার রাস্তার মোড় পেলাম। সেখানে একজনকে জিজ্ঞেস করে পঞ্চগড়ের রাস্তা ধরলাম। পথে একটা সেতুর মতো পেলাম মানে আগে সেতু ছিল কিন্তু এখন সেতু নেই আর পানিও নেই। তাই পাশ দিয়ে লোকজন পারাপার হচ্ছে। আমিও সবার সঙ্গে পার হলাম সেই ছোট বালুর নদী।

মারোয়া পার হয়ে একটা বাজার পেলাম নাম ফুলতলা হাট। সেখানে যেতে যেতে আরো এক সাইকেল সঙ্গী পেয়ে গেলাম। উনার সঙ্গে কথা বলে ভালই লাগলো। তিনি আমার সম্বন্ধে অনেক কিছু জানলেন। আমিও উনার সম্বন্ধে কিছু জানার চেষ্টা করলাম। উনি বিকম পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন এখন চাকরীর চেষ্টায় আছেন। তিনি আমার সঙ্গে পঞ্চগড় পর্যন্ত আসলেন। আমাকে থাকার জন্য ভাল একটি হোটেল দেখিয়ে দিলেন। তিনি একদম হোটেলের গেইট পর্যন্ত আসলেন। সেখান থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।
যে হোটেলে উঠলাম সে হোটেলের নাম হোটেল হিলটন। খাতায় নাম লিখে আমার রুমে ঢুকলাম। ঢুকে একটা ঘুম দিলাম। ঘুম থেকে উঠলাম বিকালের দিকে। বের হয়ে খাওয়া দাওয়া করে ঘুরাফেরা করে রুমে ফিরে আসলাম।
এমন সময় এক মহিলা আসলেন রুম পরিষ্কার করার জন্য। কথায় কথায় আমার সঙ্গে কিছু গল্প করলেন। তাঁকে খুব সহজে বুঝানো গেল না আমি কেন বের হয়েছি। তিনি ভাবলেন আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছি। গরগর করে নিজেই নিজেকে বলতে থাকলেন। এভাবে কেউ কাউকে বের হইতে দেয় বাসা থেকে কেউ কিছু বললেন না কেন?
তারপর নানা রকম প্রশ্ন, ‘আপনা মা কিছু বলে নাই?’ আমি বললাম, ‘না।’ তারপর শুরু করলেন নিজে নিজেই কথা। ‘হুমম তাহলে আপনে বাসা থেকেই পালাইছেন, আমি বুঝতে পারছি।’ উনাকে কোন কিছুই না বুঝাইতে পাইরা। বাবাকে ফোন দিলাম। এমনিতেই বাবাকে প্রতিদিনই একবার ফোন দিতাম যাতে চিন্তা না করে। তাই এখানে উনার সামনেই ফোন দিলাম। বাবার সঙ্গে কিছু কথাবার্তার পর রেখে দিলাম। তারপর ফোন দিলাম রুমা আপাকে উনাকে অবশ্য আমি আম্মা বলেই ডাকি। তো রুমা আপার সঙ্গে কথা বলার সময় ঐ মহিলা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে ছিলেন।
ফোন রাখার পর তিনি কিছুটা নিশ্চিন্ত হলেন যে আমি বাড়ি থেকে পালাই নাই। তবে তিনি কিছুতেই বুঝতে পারছিলেন না আমি কেন বের হইছি। কেউ কি কোন কাজকাম ছাড়া এভাবে দেশ দেখতে বের হয়!
পঞ্চগড় শহরে এই নিয়ে আমি দ্বিতীয়বার আসলাম। প্রথমবার যখন এসেছিলাম তখনও সাইকেল ভ্রমণেই। আমার তেঁতুলিয়া টেকনাফ সাইকেল ভ্রমণে। তখন এই শহরে এত বিল্ডিং চোখে পড়ে নাই। এই অল্প কয়েকদিনে অনেকগুলা বিল্ডিং হয়েছে। রাস্তায় একটা মজার দৃশ্য চোখে পড়ল, বাসের ছাদে করে দুটি ছাগল নিয়ে যাচ্ছে। ছাগল দুটি আবার ডানে-বামে তাকিয়ে দেখছে (মানে প্রকৃতির সোভা উপভোগ করছে)। ছাগলগুলো এত অবাক হয়ে আশেপাশে তাকাচ্ছিল দেখতে বেশ মজা লাগছিল।
