৬৪ জেলায় যা দেখেছি–২১

২১ মার্চ (পঞ্চগড় থেকে ঠাকুরগাঁও হয়ে দিনাজপুর)

পঞ্চগড় থেকে সকাল সকাল রওনা দিলাম। ইচ্ছা ঠাকুরগাঁও হয়ে দিনাজপুর পৌঁছানো। ঠাকুরগাঁও থাকার ইচ্ছা নাই কারণ পঞ্চগড় থেকে ঠাকুরগাঁওয়ের দূরত্ব খুবই কম। আমি চাইলেই দিনাজপুরে চলে যেতে পারবো তাই এই সিদ্ধান্ত।

কিছুক্ষণ চালানোর পরেই দেখি বিশাল জ্যাম। সাইকেলের জন্য জ্যাম সমস্যা না। তবে এই রকম একটা জায়গায় জ্যাম হবে আশা করি নাই। কিছুদূর আগানোর পরে বুঝতে পারলাম জ্যামের কারণ। একটি জুট মিলের শ্রমিকেরা রাস্তা বন্ধ করে রেখেছে। জুট মিলের নাম জেম জুট মিল। দুই পাশের রাস্তাই একদম বন্ধ, বাস-ট্রাকেট লম্বা লাইন।

আমার সাইকেল তারা আটকালো না। শুধু সাইকেল না, মোটরসাইকেল, রিক্সা-ভ্যান ছেড়ে দিচ্ছিল। কিন্তু বাস-ট্রাক যেতে দিচ্ছিল না। জুট মিলের ঝামেলা পার করে বোদা নামক একটি জায়গায় সকালের নাস্তা করলাম। ভুল্লী নামের একটা নদীর উপর দিয়ে পার হলাম। সেতুটা খুবই ছোট, সেতু পার হওয়ার পরেই ভুল্লী বাজার। সাইকেল চালাতে চালাতে মনে হচ্ছিল সাইকেলের পাম্প কম, তাই থেমে পাম্প দিলাম।

এক সময় ঠাকুরগাঁও পৌঁছালাম। চাইলে ঠাঁকুর শহরে না ঢুকে বাইপাস দিয়ে সরাসরি দিনাজপুর চলে যেতে পারতাম। কিন্তু ঠাকুরগাঁও শহরটা একটু ঘুরে দেখার জন্য শহরে ঢুকলাম। আর পূর্ব পরিচিত এক বড় ভাই আছেন মামুন ভাই। তাঁর সঙ্গেও দেখার করার ইচ্ছা। মামুন ভাইয়ের এক ছোট ভাই ছিলেন পাপুন ভাই। তিনি অবশ্য বেঁচে নাই, কয়েকবছর আগে একুশে ফেব্রুয়ারির রাতে তিনি মারা যান। তিনি মারা যাওয়ার সময় আমিও উপস্থিত ছিলাম। তাই এই ঠাকুরগাঁও অথবা মামুন ভাইয়ের প্রতি আলাদা একটা টান অনুভব করি। সব সময়ই মনে পড়ে পাপুন ভাইয়ের কথা আর উনার জন্যই মামুন ভাইয়ের কথাও মনে পড়ে।
38392_1508302517414_2705327_n
শহরে ঢুকার মুখেই মামুন ভাইকে ফোন দিলাম। মামুন ভাই ফোনে বলে দিলেন কিভাবে যেতে হবে। বঙ্গবন্ধু সড়কে বলাকা সিনেমা হলের ঠিক উল্টা পাশে। বলাকা সিনেমা হলটার কথাই আমার মনে থাকলো। লোকজনকে জিজ্ঞাসা করে বলাকা সিনেমা হলের সামনে চলে গেলাম। সিনেমা হলের ঠিক উল্টা পাশেই উনাদের দোকান। দোকানের নামটা মামুন ভাই পাপুন ভাইয়ের নামেই রেখেছেন, পাপুন সেল।

মামুন ভাইয়ের সঙ্গে অনেক গল্পগুজব হলো। হালকা খাওয়াদাওয়াও করে নিলাম বলাকা সিনেমা হলের পাশেই একটা হোটেল ছিল সেই হোটেলে। মামুন ভাই থাকার কথা বলেছিলেন কিন্তু আমার ইচ্ছা দিনাজপুর চলে যাওয়া। উনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দিনাজপুরের পথে রওনা দিলাম।

ঠাকুরগাঁর শহর ছাড়ার পর দুই দিকে কোন গাছপালা পেলাম না। অনেক গরম লাগছিল। কিছুক্ষণ চালানোর পরে একটা নদী পেলাম, নদীর নাম নর্থ। আর সেতুটার নামও অদ্ভুত লাগলো সত্যপীর। যদিও নামটা কেউ হাতে লিখে রাখছিল। আসলেই এই নাম কিনা আমার জানার কোন উপায় ছিল না। সেতু পার হওয়ার পর কিছু গাছপালা পাওয়া গেল তবে সেগুলা আমার জন্য এখন কাজের না। নতুন নতুন গাছের কারণে কোন ছায়া পাওয়া যাচ্ছিল না। তবে বছর দুইতিন পরে যখন বড় হবে তখন সাইক্লিস্টের জন্য কাজে লাগবে।

আরেকটা বিষয় লক্ষ্য করলাম অতিরিক্ত গাছ থাকলে একটা সমস্যাও হয়। বিশেষ করে এই ধরনের বিশ্বরোডে। বিশেষ করে যখন বাক থাকে, অপর দিকের গাড়ি দেখা যায় না। অবশ্য রাস্তা সোজা হলে কোন সমস্যা নাই।

সাইকেল চালাতে কিছুটা গরম লাগলেও আগের দুই দিনের চাইতে কিছুটা কম লাগলো। মনে হয় এখানকার আবহাওয়ার সঙ্গে শরীর মানিয়ে গেছে তাই। কারণ রোদের প্রকট যে খুব একটা কমেছে তা না, আগের মতই আছে। কিছুদূর যাওয়ার পর কবিরাজ বাজারে থামলাম দুপুরের খাওয়ার জন্য। ছোট্ট একটা হোটেল কিন্তু খাবার বেশ ভাল। সাধারণত দুপুরে আমি ভাত খেতাম না কিন্তু এখানকার খাবার দেখে খেতে ইচ্ছা করলো। মাছ-ভাত খেলাম, খাবার বেশ স্বস্তা। অবশ্য দক্ষিণের চাইতে উত্তরের খাবারের দাম এমনিতেই কম ছিল।

খাওয়া শেষে আবার সাইকেলে উঠলাম। কিছুক্ষণ পরেই পেলাম বীরগঞ্জ নামে এক উপজেলা। উপজেলাটা বেশ বড় মনে হল। অনেক দোকানপাট, এমনও হতে পারে শুধুমাত্র দুই পাশের রাস্তাতেই দোকানপাট। বীরগঞ্জের পরে বড় বড় গাছ দেখতে পেলাম। রাস্তায় অনেক ছায়া সাইকেল চালাতে খুব একটা কষ্ট হচ্ছিল না। বেশ সবুজ চারিদিকে, ভাল লাগছিল দেখতে।

আরো কিছুদূর আসার পর একটি বাজার পেলাম, বাজারের নাম গরের হাট। গরের হাট ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। সাইনবোর্ডে দেখলাম কান্তজি মন্দির ভিতরের দিকে। এর আগেও আমি এসেছি মন্দিরে। তাই এবার আর মন্দির দেখার জন্য আগ্রহ বোধ করলাম না। দিনাজপুরের দিকেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।

কিছুদূর আগানোর পরেই টায়ার টিউব বাস্ট হলো। আমার কাছে টায়ার ছিল তাই আর সমস্যা হলো না। নতুন টায়ার লাগিয়ে আবার রওনা দিলাম। দশমাইল নামের এক জায়গায় এসে রাস্তা দুই দিকে চলে গেল। একটি বাম দিকে সেটি সৈয়দপুর হয়ে রংপুর। আরেকটি দিনাজপুরের দিকে। আমি দিনাজপুরের দিকে রওনা দিলাম। দিনাজপুরের রাস্তায় যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অনেক বড় বড় স্থাপনা চোখে পড়ছিল। যেমন: ব্র্যাকের ট্রেনিং সেন্টার। এ ছাড়াও দিনাজপুর ক্রিয়া শিক্ষার একটা স্থাপনা। অনেকটা বিকেএসপির মতো, ভিতরে খোলা মাঠ বিল্ডিং। গম উৎপাদন কেন্দ্র, এখানে গমের উপর গবেষণা করা হয়। হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে দাঁড়িয়ে একটা ছবি তুললাম।
35954_1521242920916_5924076_n
দিনাজপুরে ঢুকার আগেও দুইটা রাস্তা একটা শহরের দিকে গেছে আরেকটি বামদিক দিয়ে বাইপাস হিসেবে ফুলবাড়ির দিকে চলে গেছে। আমি শহরের দিকে রওনা দিলাম। ঢুকার আগে ফোন দিলাম বাবু ভাইকে। বাবু ভাইয়ের নাম্বারটি চট্টগ্রামের জাফর ভাই দিয়েছিলেন। বাবু ভাই এখানকার স্থানীয়। বাবু ভাই বলে দিলেন কিভাবে যেতে হবে। পাশাপাশি উনি আমার জন্য একটা হোটেলও নির্বাচন করে রেখেছেন যেখানে কিছুটা কম খরচে থাকা যাবে।

বাবু ভাইকে খুঁজে বের করলাম তিনি আমাকে হোটেল দেখিয়ে দিলেন। আর বিশ্রাম নিতে বলে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে আবার তিনি ফিরে আসলেন আর সঙ্গে করে নিয়ে আসলে কিছু বিস্ময়। হাতে করে কয়েকটা পত্রিকা নিয়ে এসেছেন। প্রথমেই আমাকে বললেন আপনে আমাকে না চিনলেও আমি কিন্তু আপনাকে চিন্তে পেরেছি। আমি আগে যেসব ভ্রমণ করেছিলাম এবং ভ্রমণের খবরগুলা কিছু পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। সেইসব পত্রিকা তিনি সংগ্রহ করে রেখেছেন। সেগুলা আমাকে দেখাচ্ছিলেন, আমি কল্পনাও করি নাই এইরকম এক জায়গায় তিনি ভ্রমণ বিষয়ক সকল কিছু সংগ্রহ করে রাখেন। শুধু আমার ভ্রমণ না, ভ্রমণ নিয়ে যাই পান তাই তিনি পড়েন আর সংগ্রহ করে রাখেন। সেখান থেকেই তিনি আমাকে যেসব খবরে পাওয়া গেছে সেগুলা তিনি দেখাচ্ছিলেন। বেশ মজা লাগছিল তা দেখতে।

আজকে আর একা একা শহর দেখতে বের হলাম না। বাবু ভাই সঙ্গী হলেন। তিনিই আমাকে বিভিন্ন জায়গা ঘুরে দেখালেন। শহরের প্রাচীন স্কুল, কলেজ, রেলস্টেশন, জেলাপ্রশাসকের কার্যালয়, বিশাল এক মাঠ দেখালেন এখানে অনেকেই আড্ডা দেন। বাবু ভাই-ই বললেন এটা দিনাজপুর শহরের সবচাইতে বড় মাঠ। এই পর্যন্ত যতগুলি শহর দেখেছি এই মাঠটি সবচাইতে বড়।

মাঠের পাশেই একটি খোলা জায়গায় বাণিজ্যমেলা চলছিল। ঘুরে ঘুরে দুইজনে মেলা দেখলাম। ঢাকা শহরে বাণিজ্যমেলা দেখেছি কিন্তু ঢাকার বাইরে এসে দেখতে পাবো বুঝতে পারিনি। আরো কিছুক্ষণ ঘুরাফেরা করে একটি বাড়ি দেখিয়ে বললেন এটি বেগম খালেদা জিয়ার মায়ের বাড়ি, এখানে নাকি খালেদা জিয়াও থাকতেন।

ঘুরাঘুরি শেষে খাওয়া-দাওয়ার জন্য একটি হোটেলে ঢুকলাম। দোকানটি অনেকটা পুরান ঢাকার দোকানের মত লাগছিল। খাওয়া শেষে তিনি আমাকে আবার হোটেলে পৌঁছে দিলেন। হোটেলে ফেরার আগে একটা নতুন টায়ার কিনে নিয়েছিলাম। কারণ পথে যদি আবার টায়ার বাস্ট হয় তখন বিপদ হবে। দিনাজপুর জেলাটা অনেক বড়। মোটামুটি সকল দোকানই আছে। জেলা শহর হলেও আমার কাছে দেখতে বিভাগীয় শহরের মতই লাগছিল।

Comments

comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.