৮ মার্চ (সিলেট থেকে সুনামগঞ্জ হয়ে দৌলতপুর {নেত্রকোনা})
কিভাবে সুনামগঞ্জে যেতে হবে রাস্তার বর্ণনা নিয়ে নিলাম হোটেলের মালিকের কাছ থেকে। উনি রাস্তার দিক নির্দেশনা দিয়ে দিলেন। সিলেট শহর ও হযরত শাহজালাল এর মাজারকে বিদায় জানিয়ে রওনা দিলাম সুনামগঞ্জ জেলার উদ্দ্যেশে। হোটেল মালিকের দেখানো পথ ধরেই রওনা দিলাম। সিলেট শহর থেকে যখন বের হই তখন ঘড়িতে ৭:৩০ মিনিট। কিছুদূর সাইকেল চালানোর পর চোখে পড়লো ‘হযরত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়’। বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম দেখে প্রথমেই মনে পড়লো মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের নাম। বাংলাদেশের লেখকদের মধ্যে স্যারের লেখা আমার বেশ পছন্দ।
প্রায় তিন ঘণ্টা সাইকেল চালানোর পর শহরের কোলাহল ফেলে বিশ্বরোড ধরে এগুতে থাকলাম সামনের দিকে। পথে এক জায়গায় সকালের নাস্তা শেষ করে নিলাম। রাস্তা বেশ ভালো, যেদিকেই তাকাই দৃষ্টি সীমার শেষ সীমানা পর্যন্ত খোলা মাঠ।
সবই ফসলের মাঠ, লোকজনের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম। এই ফসলের মাঠ বর্ষায় চারিদিকে শুধু পানি থই থই করে। পানি ছাড়া আর কিছুই দেখা যায়। মাঝখান দিয়ে শুধু রাস্তাটা ভেসে থাকে। কখনো আবার রাস্তাও ডুবে যায়। তখন স্থানীয় লোকজন একটু সমস্যায় পড়ে। সিলেট শহরের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ হয়ে যায়। আরো জানতে পারলাম এখানকার ফসল এক মৌসুমি ফসল। এক মৌসুমি ফসল মানে বছরে একবারই ফসল উৎপন্ন হয়। তার কারণ একটা সময় মানে গ্রীষ্মকালে শুধু ফসল উৎপন্ন করা হয় বাকি ছয় মাস পানিতে ডুকে থাকে। তখন কিছু মানুষ মাছ ধরার উপর ঝুকে।
কদিন ধরে বিশরোড ধরে চলছি, বিশ্বরোডকে কেন্দ্র করে অনেক স্কুল-কলেজ, ছোট-বড় অনেক বাজার দেখেছি। সেই বাজারে বিচিত্র নাম, এই রাস্তায়ও বেশ কিছু স্কুল-কলেজের দেখা পেয়েছি এবং কয়েকটি বাজারও এর মধ্যে একটি বাজার পেলাম নাম ‘জাওরা বাজার’; ভাবছিলাম আরো যে কত বৈচিত্রময় বাজারের নাম দেখবো! তা ভ্রমণ শেষ করলে বোঝা যাবে। সঙ্গে আরো দেখবো আমাদের সৌন্দর্য্যময় দেশটাকে।
কিছুদূর এগুনোর পর, একটা ব্রীজ পড়লো নদীর নাম মহশীন নদী। ব্রীজ পার হওয়ার পর পরই সামনে দুই বালককে দেখলাম। তাঁরা ছোট ছোট মাছ ধরে বাড়ি ফিরছে। কাধে জাল এবং হাতে পাতিল, সেই পাতিলে মাছ ধরে রাখা হয়। তাদেরকে দেখে বেশ ভালো লাগলো। ওদের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললাম ছবি তুললাম। তারপর রওনা দিলাম বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিমের শহর সুনামগঞ্জের দিকে। সুনামগঞ্জ নামটা সামনে আসলেই সবার আগে চোখের সামনে ভেসে উঠে দুটি মুখ একজন শাহ আবদুল করিম আরজন হাছন রাজা। সুনামগঞ্জ শহরে পৌঁছালাম বিকাল ৪ টার দিকে।
প্রথমেই গেলাম ডিসি সাহেবের সাথে দেখা করার জন্য। অনেক্ষণ বসে থাকার পর তার দেখা পাওয়া গেল। আমার সব কথা না শুনেই বললেন, ‘দেখুন এই মাসে আমরা আরো কয়েকজন সাইক্লিস্টকে এটেন্ড করেছি, আর কোন সাইক্লিস্টকে কোন সহযোগীতা করতে পারবো না।’ আমি তাকে বুঝিয়ে বললাম, ‘আমি আপনার কাছ থেকে থাকা-খাওয়ার কোন সহযোগীতা চাচ্ছি না, আমার থাকার ব্যবস্থা আছে। আপনি যদি আমার ডাইয়েরীতে দুই/একটা লাইন লিখে দেন?’ তিনি প্রচণ্ড ব্যস্ততার ভান করে বললেন, ‘আমি প্রচণ্ড ব্যস্ত আমি কিছু লিখে দিতে পারবো না।’ আমি তার উত্তরে বললাম, ‘ঠিক আছে, আমি তাহলে এনডিসি সাহেবের কাছ থেকে কিছু লিখে নিয়ে যাই। যদি আপনি অনুমতি দেন?’ তিনি মনে হয় এই প্রস্তাবে হাপ ছেড়ে বাঁচলেন, সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দিলেন, ‘ঠিক আছে।’ আমার নতুন মিশন শুরু হলো এনডিসি সাহেবের রুম খোঁজা। তেমন কোন ঝামেলা ছাড়াই খুঁজে পেলাম এনডিসি সাহেবের রুম।
এনডিসি সাহেবের রুমে ঢুকলাম সালাম দিয়ে। তিনি বেশ ব্যস্ত, তবে ডিসি সাহেবের মতো ভান করা ব্যস্ততা না। তিনি সত্যি সত্যিই ব্যস্ত। তাঁর সামনে ফাইলের স্তুপ। ফাইলে সই করতে করতেই আমার সঙ্গে কথা বলা শুরু করলেন। প্রথম কথাই এই রকম, ‘আপনার মতো বয়সে আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে সাইকেল ভ্রমণে বের হয়েছিলাম, বাসের ছাদে করে জেলার কাছাকাছি গিয়ে নেমে যেতাম। তারপর জেলা শহরে ঢুকতাম সাইকেল চালিয়ে। তা আপনি আমাদের মতো এই কাজ করেন নাই তো?’ তাঁর সঙ্গে গল্প করতে বেশ মজা লাগছিল। আমি উত্তরে বললাম, ‘স্যার আমি আসলে দেশকে জানতে, দেশের মানুষকে দেখতে এবং বুঝতে এসেছি। বাসের ছাদে করে গেলে তো এই সবকিছুই মিস করবো, এবং নিজের কাছে অপরাধী হয়ে থাকবো। তা ছাড়া আমি স্কাউট থেকে আসিনি যে সাইকেল ভ্রমণ শেষ করলে আমি কোন সার্টিফিকেট পাব। আমার এই ধরনের কোন উদ্দেশ্য নেই।’ আমি বেশ সহজ ভঙ্গিতে হাসতে হাসতেই বললাম।
তিনিও বেশ আনন্দ পাচ্ছিলেন আমার সঙ্গে গল্প করে বোঝা যাচ্ছিল। তিনি কথার ফাঁকে বললেন, ‘আমি কিন্তু আপনার থাকার ব্যপারে কোন সহযোগীতা করতে পারবো না, তবে ডাইয়েরীতে দুটি লাইন লিখে দিচ্ছি এবং সিল দিয়ে দিচ্ছি। আর দেখতেই তো পাচ্ছেন কি পরিমাণ ব্যস্ততার মধ্যে থাকতে হয়।’ আমি অবশ্য থাকার বিষয়ে কোন অনুরোধ করিনি, কারণ কোরাইশী ভাই আমার থাকার ব্যবস্থা আগেই করে রেখেছেন। রুমে বসে বসে কিছুক্ষণ তাঁর ফাইলে স্বাক্ষর করা দেখলাম। স্বাক্ষর শেষে দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করে, আমার ডাইয়েরীতে দুটি লাইন লিখে দিলেন।
ডিসি অফিস থেকে বের হয়েই দেখলাম মহিলাদের একটি মিছিল, তাদের অধিকার আদায়ের জন্য এই মিছিল। তাদের ব্যনারে লেখা দেখে বুঝতে পারলাম আজ নারী দিবস, এই উপলক্ষ্যেই মিছিল। ভেবেছিলাম শুধু ঢাকা শহরেই নারীরা স্বক্রীয়, কিন্তু এই গানের দেশে এসে আমার ধারণা অনেকটা ভুল প্রমানিত হলো।
ফোন করলাম ইঞ্জিনিয়ার জামাল হোসেন ভাইকে, জামাল ভাই কোরাইশী ভাইয়ের পরিচিত, তিনি আমাকে বললেন উপজেলা পরিষদের কাছে যাওয়ার জন্য, সেখানেই তিনি থাকেন। লোকজনকে জিজ্ঞেস করতে করতে পৌঁছে গেলাম উপজেলা পরিষদে। আমাকে দেখে জামাল কিছুটা বিব্রতবোধ করছিলেন। মূলত আমার পোশাক-আশাক, চুল-দাড়ি এসবই তাঁর বিব্রতর কারণ এবং সেটা তাঁর চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে।
তবে সেই বিব্রত ভাব কিছুক্ষণের মধ্যেই দূর হয়ে গেল। যখন সব কিছু শুনলেন আমার উদ্দেশ্য। কোরাইশী ভাই কিছুই বলেননি তাকে। তিনি বললেন, ‘আমি তো তোকাকে প্রথমে ভাবছিলাম তুমি ফকিরি লাইনে আছো।’ তাঁর কথা শুনে দুজনেই হাসলাম।
যাই হোক খাওয়া-দাওয়ার পর বের হলাম শহরটা একটু দেখার জন্য এবং নেত্রকোনা যাওয়ার জন্য তথ্য যোগার করার জন্য। স্থানীয় লোকজন কেন জানি খুব ভাল কিছু বলতে পারলেন না। তাই সোজা চলে গেলাম সুনামগঞ্জ থানায়, থানায় দায়িত্বে থাকা একজনকে আমার উদ্দেশ্য বললাম। তিনি সব কিছু শোনার পর খুশি মনেই বললেন, ‘আপনার সবচেয়ে ভাল হবে, আপনি যদি এখান থেকে লঞ্চে চলে যান। লঞ্চে দৌলতপুর নামে এক জায়গা আছে, সেখান থেকে আপনি সাইকেল চালিয়ে নেত্রকোনা পৌঁছাতে পারবেন।’
সবকিছু শুনে, চলে গেলাম লঞ্চঘাটে সেখানে খোজ নিয়ে জানতে পারলাম রাত ১১ টায় লঞ্চ ছাড়ে এবং দৌলতপুর পৌঁছুতে পৌঁছুতে ভোর হয়। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ঠিক করলাম কি করা যায়? রাতে থাকলেও আগামীকাল সারাদিন এখানেই থাকতে হবে, কারণ রাতে ছাড়া কোন লঞ্চ নেই। সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম আজ রাতেই রওনা দেব।
ফিরে আসলাম উপজেলা পরিষদে সেখানে জামাল ভাইকে সব খুলে বললাম। তিনি শুধু রাতে খেয়ে যেতে বললেন এবং রাতে থাকার জন্যও অনুরোধ করলেন, কিন্তু কেন জানি তার এখানে থাকতে ইচ্ছা করলো না। রাতে খাওয়া শেষ করে রওনা দিলাম লঞ্চঘাটের দিকে। বিদায় দেয়ার সময় জামাল শুধু বললেন, ‘যদি কখনো তোমার ভ্রমণের উপর বই লেখ, অবশ্যই আমাকে এক কপি দিও।’ তাঁর সঙ্গে গল্প করার সময় বলে ছিলাম ভ্রমণ শেষে হয়তো একটা বই লিখবো। তাই বিদায়ের সময় তাঁর এই অনুরোধ।
লঞ্চে উঠতে তেমন সমস্যা হলো না, জিনিশপত্র রাখার পর কিছুক্ষণ এখানে সেখানে ঘুরলাম রাত ১১ টা ১০ মিনিটে লঞ্চ ঘাট থেকে ছেড়ে দিলো। লঞ্চে বাসের সিটের মতো বসার জায়গা। টিকেটে সিটের নাম্বারও দেয়া, রাতে খুব একটা ভাল ঘুম হলো না। কয়েকবার বাইরে লঞ্চের বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করলাম। এভাবেই কিছুক্ষণ হেঁটে কিছুক্ষণ বসে রাতটা কাটিয়ে দিলাম।


[…] ৬৪ জেলায় যা দেখেছি–৮ […]