৯ মার্চ (দৌলতপুর থেকে কলমাকান্দা–নেত্রকোনা)
ভোরে লঞ্চ নামিয়ে দিলো দৌলতপুরে। লঞ্চ থেকে নামকে কিছুটা সমস্যা হলো কারণ এখানে কোন জেটি নেই সিড়ি দিয়ে নামতে হলো। লঞ্চের সকল যাত্রী নামার পর আমি নামলাম। সিড়ি দিয়ে সাইকেল এবং বেগ নিয়ে একসঙ্গে নামা কঠিন। তাই একবার সাইকেল পরেরবার বেগ নামালাম। লোকজনদের জিজ্ঞেস করে রাস্তা দেখে নিলাম।
সাইকেলে উঠতে গিয়ে দেখি সাইকেলের পেছনের চাকায় পাম্প নেই। বেগ থেকে পাম্পার বের করে পাম্প দেয়ার চেষ্টা করলাম কিন্তু কোনভাবেই পাম্প দিতে পারলাম না। মনা ভাইয়ের কাছ থেকে আনা পাম্পারটা কেন জানি কাজ করছে না। বাজারে জিজ্ঞেস করলাম এই ভোর বেলা কোন রিক্সা ঠিক করার দোকান পাওয়া যাবে কিনা? লোকজন সব শুনে একটি দোকান দেখিয়ে দিলো। দোকানটি মূলত চায়ের দোকান কিন্তু পাম্পারও আছে। এই দোকানে পাম্পার কোথা থেকে এলো এটা আমার কাছে ঠিক বোধগম্য হলো না। আমি এত কিছু চিন্তাও করতে গেলাম না, বিপদ থেকে উদ্ধার পাচ্ছি এটাই বড় কথা।
লোকজনের তথ্য মতে আমাকে যেতে হবে প্রথমে ধর্মপাশা তারপর মোহনগঞ্জ এরপরে নেত্রকোনা। লোকজন যে রাস্তা দেখালো, সেটা রাস্তা বললে ভুল হবে। এটা আসলে পায়ে চলা পথ, দুইধারে ধানক্ষেত। মাঝখান দিয়ে পায়ে চলা পথ। বাহন একমাত্র সাইকেল আর মটরসাইকেল তবে কিছু ভ্যান ও রিক্সাও আছে। অনেক লোকজন পায়ে হেটেই রওনা দিয়েছে। সাইকেল চালাতে বেশ কষ্ট হচ্ছিলো। একে তো পায়ে চলা পথ সঙ্গে বোনাস হিসেবে বালি। তার উপর আমার সাইকেল চিকোন চাকার অর্থাৎ রোডবাইক যেটা ভ্রমণে অফরোড হলে খুব সমস্যা করে, মোটা চাকা হলে তেমন সমস্যা হতো না। বাড়তি সতর্কতার সঙ্গে চালাতে হচ্ছে। বর্ষাকালে দুইধারে পানি ছাড়া কিছুই দেখা যায় না, এটা বুঝতে আমার বাকি রইল না। সেই কারণেই এখানে রাস্তা তৈরি করা হয়নি।
কিছুদূর চালানোর পরই একটি খাল, সেটা পার হওয়ার জন্য নৌকায় উঠতে হলো, পুরো নৌকাতে কয়েকজন লোক, একটি রিক্সা এবং আমার সাইকেল। এর আগে কখনো নৌকা দিয়ে রিক্সা পার হওয়া দেখার কোন অভিজ্ঞতা ছিলো না। এবারে সেই অভিজ্ঞতা হলো, এবং রিক্সা নৌকাতে উঠানোটা অনেক কষ্টের কাজ। নৌকার মাঝি, রিক্সাওয়ালার সঙ্গে আমাকেও হাত লাগাতে হয়েছে।
ভাল-খারাপ রাস্তা দিয়ে পৌঁছালাম ধর্মপাশা। পথে অনেক বাড়িতেই ডজন ডজন হাঁস দেখলাম। বুঝতে পারলাম এখানকার লোকজন মুরগীর চাইতে হাঁস পালন করে বেশি। হয়তো হাওর অঞ্চল বলেই হাঁস পালনের রীতিটা অনেক বেশি। অন্যান্য অঞ্চলে মনে হয় এই দৃশ্য খুব একটা দেখা যাবে না। এইসব চিন্তা করতে করতেই পৌঁছে গেলাম ধর্মপাশা। সেখানে সকালের নাস্তা করে রওনা দিলাম মোহনগঞ্জের পথে এর আগেই দোকান থেকে জেনে নিয়েছিলাম কোন রাস্তা দিয়ে যেতে হবে।
এখানকার রাস্তায় প্রথম সাইকেল চালালেও এখানকার জায়গার নামগুলো আমার কাছে পরিচিত। কারণ এত বেশি হূমায়ুন আহমেদের বই পরেছি যে তাঁর লেখার বেশির ভাগ গ্রামের কাহিনীতেই এই নামগুলো অনেক বেশি করে এসেছে। এসেছে ভাটি অঞ্চলের অনেক গ্রামের কথাও। তাই প্রতিবার যখন ধর্মপাশা, মেহানগঞ্জ, বারহাট্টা এবং কলমাকান্দা নামটা শুনছিলাম বা বলছিলাম ঠিক ততবার এই লেখকের নামটা মনের মধ্যে উকি দিয়েছে।
মোহনগঞ্জের পথে সাইকেল চালানো অবস্থাতেই ফোন করলাম ছোট ভাইয়ের বন্ধু সাইফুলকে। সাইফুল আগে থেকেই বলে রেখেছিলো, নেত্রকোনা গেলে যেন অবশ্যই সাইফুলের ওখানে থাকি। সাইফুলকে ফোন করার পর সে জানিয়ে দিলো মোহনগঞ্জ পার হওয়ার পর বাহারহাট্টা নামে একটি জায়গা আছে সেখানে লোকজনদের বলতে হবে কলমাকান্দা, সে কলমাকান্দাতেই থাকে। রাস্তার অবস্থা ভয়াবহ খারাপ, বেশ কষ্ট হচ্ছিল সাইকেল চালাতে। রাস্তা মেরামতের কাজ চলছে তাই অনেক জায়গায় শুধু বালু, বালুতে সাইকেল ঠেলে যাওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই।
বাহারহাট্টার পর রাস্তা কিছুটা ভাল পাওয়া গেলো তবে সেই রাস্তা সাপের মতো আঁকা-বাঁকা রাস্তা। প্রায় ২০ কিলোমিটার চালানোর পর পৌঁছালাম কলমাকান্দা। পথে ৪/৫ টা প্রাথমিক বিদ্যালয় চোখে পড়লো। কলমাকান্দা পৌঁছানোর ঠিক আগে থেকে আবার বালুর রাস্তা শুরু হলো, শেষ তিন কিলোমিটার খারাপ রাস্তা দিয়ে যেতে হলো। সাইফুল আমার জন্য রাস্তাতেই অপেক্ষা করছিলো। বেশ ক্লান্ত লাগছিলো।
সাইফুলের রুমে ঢুকে কোন রকমে হাতমুখ ধুয়েই বিছানায় শরীর ছেড়ে দিলাম। একে তো ভাঙ্গা রাস্তা তার উপর গত রাতে ঘুমাতে পারিনি তাই শুয়েই ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম থেকে উঠলাম বিকালে, পেটে প্রচণ্ড ক্ষুদা। হয়তো ক্ষুদার কারণেই ঘুম ভাঙ্গলো। প্রথমেই খেয়ে নিলাম, খাবারের মেনু মাছ সবই হাওয়ের মাছ। জানতে পারলাম এখানে মাছ খুব সস্তা। মাছ মুখে দিলেই বোঝা গেল আমরা ঢাকাতে যে মাছ খাই তা অনেক দিনের আগের মাছ। তাজা মাছ যে কত মজার হতে পারে না খেলে বোঝা মুশকিল।
খাওয়ার পর বের হলাম বাজারটা দেখার জন্য। সাইফুল এখানে পল্লী বিদ্যুৎ অফিসে কাজ করে। ওকে অবশ্য অফিসে কাজ করতে হয় না। ওর কাজ করতে হয় পাওয়ার স্টেশনে। কিছুক্ষণ পর পর ফোন আসছে, ফোনে নির্দেশনা দিচ্ছে এই এলাকার লাইন অফ করে দাও, তারপর ঐ এলাকার লাইন চালু করো। অমুক এলাকায় এমপি সাহেব যাবেন, ঐ এলাকায় যেন বিদ্যৎ থাকে রাত ৮ টা পর্যন্ত। এইসব নির্দেশনা পালন করাই ওর কাজ। ভালই লাগছিলো সরাসরি এই সব কাজ দেখতে। ঢাকায় থাকতে যেমন প্রায়ই লোডসেডিং হয়, সময় ধরে দেয়া থাকে। এখানে ঠিক তাই, অফিস থেকে ফোন দিলেই বিভিন্ন এলাকার লাইন বন্ধ করে আরেক এলাকার লাইন চালু করা হয়। এলাকায় মোটামুটি সবাই সাইফুলকে চেনে। সাইফুলের কাছ থেকে জানতে পারলাম কলমাকান্দা একদম বর্ডারের কাছে। সে কারণে এখানে ফেন্সিডিলের ব্যবসা বেশ রমরমা, দামেও সস্তা। অনেক লোক এই ব্যবসার সঙ্গে জরিত।
রাতে খাওয়ার মেনু ছিল মুরগী আর মাছ। আমার মাছ খেতেই বেশি ভাল লাগছিলো। তা দেখে সাইফুলের কিছুটা মন খারাপ কারণ সে আগ্রহ নিয়ে মুরগী রান্না করিয়েছে। এখানে মাছের চাইতে মুরগীর দাম বেশি এবং অতিথী আসলে সাধারণত মুরগী আনা হয়। কিন্তু আমার কাছে মাছই বেশি ভাল লাগছিলো কারণ মুরগী সব জায়গায় পাওয়া যায় কিন্তু এই রকম হাওরের টাটকা মাছ শহরে পাওয়া কঠিন।

[…] ৬৪ জেলায় যা দেখেছি–৯ […]