অন্ধ আমি

কাকে ঢুকার পরে রাসেল ভাইয়ের সঙ্গে সবচাইতে ভাল বন্ধুত্ব হয়েছিল। রাসেল ভাইকে নানা রকম প্রশ্নবানে জর্জরিত করতাম। উনি তার মত উত্তর দিতেন কিছু বুঝতাম কিছু বুঝতাম না। আবার উনি ঐ সময় যা বলেছিলেন হয়তো তখন বুঝতাম না কিন্তু এখন বুঝি। হয়তো বয়স কম হওয়ার কারণে অথবা জানার পরিধি অনেক কম ছিল তাই।

রাসেল ভাইয়ের কাছে প্রথম প্রশ্ন ছিল দর্শন কি? এক কথায় রাসেল ভাই উত্তর দিয়েছিলেন, ‘দেখা।’ পরে আরো বিস্তারিত বলেছিলেন সকল ইন্দ্রিয় দিয়ে দেখাই দর্শন। চোখ, কান, নাকসহ সকল ইন্দ্রিয়, যে ইন্দ্রয় দেখা যায় না ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়, সেটা দিয়েও দেখাই হলো দর্শন।

আমার স্কুলজীবনটা ছিল অ্যাডভেঞ্চারে পরিপূর্ণ। স্কুল পালিয়ে নানা জায়গায় যেতাম। সিদ্ধ-নিষিদ্ধ নানা জায়গায় ঘুরতাম। স্কুল পালানোর সুবাধে ঢাকা শহরের অনেক জায়গা চিনেছি। একদিন স্কুল পালিয়ে গ্যারিসন সিনেমা হলে গিয়েছি সিনেমা দেখতে। গ্যারিসনে টিকেটের দাম কম ছিল, তাই ঐ হলে বেশি সিনেমা দেখা হয়েছে।

কি সিনেমা দেখেছিলাম মনে নাই। সিনেমা চালু হওয়ার পর বাতি বন্ধ থাকে তাই আশে-পাশে কাউকেই দেখা যায় না। আর সবাই সিনেমার দিকেই বেশি মনোযোগ দেয় আমিও আলাদা ছিলাম না। অর্ধেক ছবি শেষ হওয়ার পর বিরতী। বিরতীতে সবাই বের হয়, টয়লেট করে, হাঁটাহাঁটি করে। কেউ কেউ নাস্তা করে। আমিও বের হলাম, ক্যান্টিনে গিয়ে সমুচা আর একটা কোক নিলাম। যেদিন টাকা বেশি থাকত সেদিন সমুচার সঙ্গে কোক খেতাম টাকা কম থাকলে শুধু সমুচা আর টাকা একদম না থাকলে কিছুই খেতাম না।

খেতে খেতে লক্ষ্য করলাম আমার পাশে দুইজন খাচ্ছে বয়স আমার চাইতে একটু বেশি। একজনের চোখে আবার সানগ্লাস। ক্যান্টিনে যে খুব বেশি রোদ ছিল তা না। বরং একটু অন্ধকারই ছিল। ভাবলাম একটু বেশিই পাংপুং করে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে খাওয়া শেষে আবিষ্কার করলাম সানগ্লাস পরা লোকটা অন্ধ। মনে মনে লোকটাকে গালি দেয়ার জন্য নিজের কাছেই খুব খারাপ লাগলো।

কিছুক্ষণ পর দেখলাম ঐ অন্ধ লোকটা হলে ঢুকছে, পাশের জন অন্ধ লোককে হাত ধরে ঢুকাচ্ছে। আমি অবাক হয়ে গেলাম অন্ধ মানুষ হয়েও সিনেমা দেখার জন্য এসেছে। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো এমনি খাওয়ার জন্য ক্যান্টিনে এসেছে। আরো কিছুক্ষণ পরে আবিষ্কার করলাম লোকটা আমার পাশেই বসেছেন। আমি এতক্ষণ খেয়ালই করি নাই।

আমার সকল দৃষ্টি সিনেমা থেকে ঐ লোকের উপর চলে গেল। এখন বুঝতে পারি লোকটা খুব মনোযোগ দিয়ে তাঁর অন্যান্য ইন্দ্রিয় দিয়ে সিনেমা দেখছে শুনছে অনুভব করছে।

অনেকদিন আগের ঘটনা এখন হঠাৎ হঠাৎ অর্থ নিয়ে চোখের সামনে উপস্থিত হয়। যার আগে কোন অর্থ ছিল না। আর সেইসব ঘটনা আমাকে বার বার পিছিয়ে দিচ্ছে প্রতি নিয়ত অথবা শুধুই সামনে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

আমার এক ফেসবুক বন্ধু আছে টুকটাক আমার লেখা পড়ে। একদিন আমায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনে এত এত গল্প কোথায় পান? নাকি বানান?’

আমার মনে হয় আমাদের সবার জীবনেই কিছু না কিছু ঘটে। আমরা দেখি না, অন্ধ। আমিও দেখি না। মাঝে মাঝে দেখা পাই তাই লিখি। অনেক সময় দেখি কিন্তু লিখতে পারি না। শুধু চিন্তাই করি।

লালনের গান আমার খুবই পছন্দ, তাঁর গান অনেক ভাবায়। তাঁর গানের কয়েকটি লাইন দিয়ে লেখাটা শেষ করি।

বাড়ির কাছে আরশী নগর
সেথায় এক পরশী বসত করে
আমি এক দিনও না দেখিলাম তারে

এই ধরনের গান শুনলে রাত নষ্ট হওয়া ছাড়া উপায় নাই। শুধু প্রশ্নই জাগে মনে, বাড়ি কি? আরশী কি? পরশী কি? আমিই বা কে?

.
১২ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৩

Comments

comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.