গ্রামে বেড়ে উঠা আমি সেই আমিই থেকে গেলাম। বদলে যায়না কোন কিছু। আজও হয়ে উঠতে পারিনি শহুরে মানুষ। কয়েক দিন পর পর যখন আমি গ্রামে ফিরে যাই তখন আবার মনে হয় আমি কখনও শহরে ছিলামই না। ২০১০ সালের কথা। তখন মাত্র এসেছিলাম ঢাকাতে। পড়তে আসা। পড়াশোনায় কখনই খুব ভাল ছিলাম না। তবুও বলব পড়তে আসার নাম করে ঘর থেকে বের হয়ে আসা। ঘর ছেড়েছি আম্মা নাই এটাকে ভুলার জন্য। কিন্তু এই ভুলাটা দারুন করে মনে করে দিল তাঁকে।
থাকতাম হোস্টেলে। হোস্টেলে আমার মত খুব কম মানুষের মা বাবা নাই। সবাই মা বাবার খুব আদরের। হোস্টেলে কি খাচ্ছে না খাচ্ছে কি করছে না করছে সারাক্ষণ ফোন দিয়ে খবর নিচ্ছে। সারাক্ষণ শুধু হ্যালো মা, হ্যালো মা শুনতে শুনতে আমি অস্থির ছিলাম। গ্রাম থেকে প্রথম শহরে আসা একজন যেমন হয়, আমি তার থেকে একটু বেশি খারাপ ছিলাম। এমন মেয়েদের আমি দেখিনি। এত সহজ! এত খোলামেলা কথা বলে! সব অস্থির করে দিচ্ছে। শহরের প্রথম অভিজ্ঞতা হল রাস্তা পার হওয়া। কেউ একজন খুব সাহায্য করেছিল যখন ঢাকায় এসেছি। রাস্তা পার হওয়ার সময় তার হাত ধরেছিলাম বলে আমায় বলে ‘তোর যদি হাত ধরছে ইচ্ছে করে তাহলে আমাকে বলিস আমিই হাত বাড়িয়ে দিব, রাস্তা পার হওয়ার নাম করে আর হাত ধরতে হবে না।’ খুব মন খারাপ হয়েছিল। আর হাত ধরে রাস্তা পার হইনি। নিজের মত করে পার হয়েছি।
আমি লক্ষ¥ীপুরের মেয়ে। ঢাকায় আসার পর সব নতুন নতুন জিনিস সামনে আসতে লাগল। এখানে আসার পর নতুন তথ্য জানলাম যে নোয়াখালির মানুষদেরকে ঢাকায় তেমন কেউ পছন্দ করে না। ‘নোয়াখাইল্লা’ নাকি একটা গালিই! কেউ কেউ বলছে ‘নোয়াখাইল্লাদের থেক্কা দূরে থাকনই ভাল। শালারা একটা জিনিসই।’ কিছুই বুঝতাম না। আমার খুব কাছের বন্ধুই এই সব তথ্য দিচ্ছে। আর আমাকে সারাক্ষণ নামে বেনামে নোয়াখাইল্লা বলছে আর হাসছে। হাসির তো কারণই বুঝতেছিনা। এটাও কেমন যেন নতুন কোন নিয়ম মনে হল।
আমি মানুষ চিনতে পারিনা। কে যে সুবিধাবাদি তা আমি বুঝতে পারিনা। আমার সাথে কেউ একটু সুন্দর করে কথা বললেই মনে হয় সে অনেক ভাল। কিন্তু কেউ কেউ নাকি নিজের কার্য উদ্ধার করার জন্য দিব্যি এমন অভিনয় করে যেতে পারে তা আমি এই ঢাকাতেই এসে জানতে পারলাম। আমার মনে হত গ্রামের মানুষগুলোর কাছেই টাকাপয়সা, গায়ের রং, বাড়িগাড়ি এইসব অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ মেয়ে বিয়ে দেওয়ার সময় বা ছেলে বিয়ে করানোর সময়। কিন্তু না এই ধারণা ভুল। শহরের মানুষগুলোও এর থেকে খুব একটা বের হতে পারেনি। সবার কাছে গুণের থেকে কদর বেশি মেকি জিনিসের। নকলের পেছনে দৌড়ানোই তাদের কাছে প্রধান। কেউ কেউ বলে মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু। আমি বলব, যে বলে সেই মেয়েদের শত্রু।
ঢাকায় পড়তে এসে আমি কিছু কিছু বিশেষ বই পড়েছি। যা গ্রামে থাকলে হয়তো পড়া হত না। বই পড়ে আমি কিছু কিছু জিনিস বুঝতে পারলেও তার থেকে বের হয়ে আসা অনেক কঠিন ছিল। আমাদের পরিবার ছিল একটু কট্টর । আমার ভাই হাফেজ। হিন্দু কারো সাথে কখনও মিশতে পারিনি কিন্তু ঢাকায় আসার পর ধর্মের কিছু কখনও আগে মাথায়ই আসেনি। জ্যোতি ভাই নামে একজন আছেন যার কাছে আমি পড়তে যেতাম। উনাকে দেখে আমার শুধু একজন ভাল মানুষই নয় অতি ভাল মানুষ মনে হত। এমন কি এখনও মনে হয়। আমার কাছে গুণি মানুষটাই বড় অন্য কিছু নয়।
ঢাকায় আসার পর দেখতে পেলাম মানুষ কত অসহায়। এখানে কেউ রোগে বা দূর্ঘটনায় পড়ে থাকলে মানুষগুলো তাদের সাহায্য করতে আসতে দ্বিধা বোধ করছেন। সবার শুধু বিপদে পড়ার ভয়। ঘরে খাবার না থাকলেও কেউ আদর করে খাওয়ানোর নেই। এখানে পাশের ঘরে আনন্দ হচ্ছে আর সাথে সাথে কারো মৃত্যুর কান্না হচ্ছে। বড় অদ্ভূত এই নিষ্ঠুর শহর। বিপদে পড়লে খুব কাছের মানুষ ছাড়া কেউ নেই পাশে দাড়ানোর মত। সবাই মুখ চেনা কিন্তু ভরসার কেউ নেই। চেনার ভিতর সব অচেনা।
.
.
সুরাইয়া বেগম
৩১ জুলাই ২০১৬