গতকাল বাসা পাল্টাইলাম। হিসাব করে দেখলাম এই জীবনে বুঝতে পারার পরে অনেকবার বাসা বা থাকার জায়গা পাল্টানো হইল। এইবারসহ প্রায় ২৩ বার হইল। আমি বুঝতে পারার আগেও নিশ্চয়ই আরো বাসা পাল্টানো হইছিল।
এতবার বাসা পালটেও দেখা গেছে অনেক জায়গায় গিয়েছি এমন না। মোটাদাগে হয়তো তিনটা এলাকায় ভাগ করতে পারবো। নাখালপাড়া, এলিফ্যান্ট রোড, লালমাটিয়া-মোহাম্মদপুর।
এর মধ্যে নাখালপাড়ায় সবচাইতে বেশি সময় বা উল্লেখযোগ্য সময় পার করেছি এবং ঐটাই আমার ভিত্তি। কোন এলাকার যদি কখনো টান অনুভব করি সব সময় নাখালপাড়া আসবে। নাখালপাড়ার নামটা এতবার লেখা আসছে, মনে হয় না আর কোন এলাকার নাম এতবার আসছে। তাই ঐ এলাকাটা আমার এক রকম শেকড় বলা যায়। এখনো খুব মন খারাপ হলে মাঝে মাঝে একা একা যাই। সাইকেল অথবা হেঁটে ঘুরে আসি।
এরপরে সবচাইতে কম সময় কাটিয়েছি এলিফ্যান্টরোডে এসে। কিন্তু এই এলাকাটায় এসে আমার মধ্যে একটা বিশাল পরিবর্তন আসছে। সময় অল্প হলেও এখানে এসে আমার জীবনের মোড় ঘুরে গেছে। আমি এখন যেই ট্র্যাকে আছি, সেটা এখান থেকেই শুরু বলা যায়। কিংকর্তব্যবিমূঢ় থেকে বেরিয়ে কিছুটা প্রত্যুতপন্নমতিত্বে ঢুকছি।
তারপর ছিলাম, লালমাটিয়া-মোহাম্মদপুর। নাখালপাড়ার পরে এই এলাকায় সবচাইতে বেশি সময় ছিলাম। এই এলাকায় অনেক বছর থাকলেও খুব বেশি বাসা পাল্টানো হয় নাই। যদিও শেষের দিকে হয়েছে। কিন্তু এক বাসাতেই প্রায় ১০ বছর ছিলাম।
এই যে এতবার বাসা পাল্টানো হয়। কেন এতবার পাল্টাতে হয়? বেশিরভাগ সময়ই দেখা গেছে ভাড়া। ভাড়া বাড়লে তখন একটু কম খরচে কোথায় থাকা যায় সেটার জন্য নতুন নতুন বাসা খুঁজতে হয়েছে। তার মধ্যে আরো আছে, কাজের সুবিধার জন্য এলাকা ছাড়তে হয়েছে।
এই ২৩ বারের মধ্যে সবচাইতে প্যাথেটিক বিষয় ছিল নাখালাপাড়ায়। ২বার আমাদের বাসা থেকে বের করে দিয়েছিল বাড়িওয়ালা। ঠিকমতো ভাড়া দিতে পারতেছিল না বাবা। প্রথমবার কিছু জিনিশপত্র রেখে দিতে চেয়েছিল, টাকা শোধ করে তারপর সেইসব জিনিশপত্র ছুটিয়ে আনতে হবে এমন কথাবার্তা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঐ পর্যন্ত যেতে হয় নাই একটা ব্যবস্থা কিভাবে যেন হয়ে গিয়েছিল। আমরা সবাই গ্রামের বাড়ি চলে গিয়েছিলাম। পরের বারও একই রকম ঘটনা ঘটেছিল। এক রাতের নোটিশে আমাদের বের হয়ে যেতে হয়েছিল। প্রথম বারের ঘটনা আমার খুব একটা মনে নাই। কিন্তু দ্বিতীয়বারের ঘটানাটা আমার স্পষ্ট মনে আছে, সেটা নিয়ে হয়তো ভবিষ্যতে কোন একদিন লিখব। ঐটা ভয়ঙ্কর একটা ট্রমার মধ্যে দিয়ে গিয়েছি বলা যায়।
গতকাল যে বাসাটা ছেড়ে আসলাম, সেই বাসার ওই বাড়িওয়ালাটা ছিল আমার দেখা বেস্ট বাড়িওয়ালা। শেষ বাসাটায় প্রায় এক বছরের চাইতে কিছুদিন বেশি ছিলাম। একদিক দিয়া চিন্তা করলে আমি এখন অনেকটা ব্যাচেলার জীবনযাপনই করতেছি। একা একটা বাসায় থাকি। এই বাড়িয়ালা এটা নিয়া খুব একটা প্রশ্নই তুলে নাই। পুরাপুরি স্বাধীনতা ছিল।
ঐখানে একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল। ঐ এলাকায় গ্যাস নাই। সবাই সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করে। কিছুদিন পরে আমার পাশের ফ্ল্যাটের এক এসে হাজির হাতে ভাতের পাতিল। উনাদের গ্যাস শেষ হয়ে গেছে হুট করে। ভাতও অর্ধেক হয়ে গেছে। তাই ভাতটা রান্না করার জন্য। ঢুকে দেখে আমি ব্যাচেলার একাই থাকি। খুবই অপ্রস্তুত একটা অবস্থা। তারপরেও একটু স্বাভাবিক হওয়ার জন্য আমরা কিছুক্ষণ গল্প করেছিলাম। কে কি করি এইসব। তারপর হুট করে উনি বললেন, আপনে যে ফ্ল্যাটে থাকতেছেন এখানে কিন্তু ইউল্যাবের একটা মেয়ে মারা গিয়েছিল। আপনে একা একা থাকেন ভয় লাগে না?
ইউল্যাবে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছিল। কিছুদিন আগেই এটা নিয়া ফেসবুকে লেখা পড়েছিলাম। একটা মেয়ে আত্মহত্যা করেছে। আর সেই ইচ্ছামৃত্যু গ্রহণ করা মেয়েটার ফ্ল্যাটেই আমি উঠলাম ভাবতেই প্রথমে একটু কেমন লাগতেছিল।
যাই হোক আমি তো তখনই মাত্র জানলাম। উত্তরে বললাম আমি তো জানতাম না, আপনার কাছ থেকেই প্রথম জানলাম। এখন দেখি ভয় লাগে কিনা, লাগলে বাসা ছেড়ে দিবনে।
কিন্তু আমি ঐখানেই রয়ে গেলাম। আমার খুব একটা সমস্যা হয় নাই। তবে আমি যেটা করলাম, এই ঘটনা আর কাউকেই বললাম না। সুরাইয়া আসছে কয়েকবার, আমি এক্সিডেন্ট করে আঙ্গুল ভাঙলাম রাসেল ভাই এসে এক রাত থেকে গেলেন। তারপর সুরাইয়া আসা মানে ওর সাথে ওর বোনের মেয়েরাও আসে। কাউকেই কিছু বলি নাই। কারণ জানি বললেই একটা ঝামেলা হবে। সাধারণ একটা শব্দকেও ওরা একটা ব্যাখ্যা বানাবে। ভয় পাবে। খুব যত্নের সাথে এই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা চেপে গেলাম।
আমার বাসাটায় বেডরুম ছিল দুইটা। কোন রুমে ঘটনাটা ঘটিয়েছে সেটা জানার খুব আগ্রহ ছিল। কিন্তু কাউকে জিজ্ঞাসা করা হয় নাই। দারোয়ানকে জিজ্ঞাসা করলেই বলে দিত। পরে আবার মনে হইল থাক না। যে রুমেই ঘটনাটা ঘটুক না কেন থাক বিষয়টা। ঐটা তাঁর ব্যক্তিগত বিষয়।
এই যে আত্মহত্যা বা ইচ্ছামৃত্যু নিয়ে আমি অনেকবার ভাবছি। মোটামুটি সব ধর্মেই এটা নিষেধ। কিন্তু এর বাইরে গিয়েও লোকজন এটা করে কেন? সবার জীবনেই এই রকম পরিস্থিতি আসে নিশ্চয়ই। আমার জীবনেও যে কয়েকবার আসে নাই তাও না। একাধিকবার আসছে। জানি সামনেও হয়তো অনেকবার আসবে।
কিন্তু এটা করি না কেন? শুধুই ধর্মের কারণে? জীবনকে ভালোবাসি? নিজেকে ভালোবাসি? ভয় পাই এই কাজটা করতে?
আর যে মানুষটা এই ঘটনাটা ঘটিয়েছে সে কোন পরিস্থিতিতে এই ঘটনাটা ঘটালো? আমরা হয়তো বুঝতে পারি না। আমাদের হয়তো বললেও বুঝতে পারি না। আমরা খুব কাছের মানুষটার কথা শুনতে চাই না। যখন তার কথা কেউ শুনতেছে না, বুঝতেছে না, সাপোর্ট পাচ্ছে না। তখনই সম্ভবত এই ঘটনাটা ঘটায়। তখন আর সে এই বেঁচে থাকার কোন অর্থ খুঁজে পায় না। তখন মনে হয় যে এই কাজটা করেছি সে ঠিক কাজটাই করেছে। আমরা দূর থেকে যতই বলি না কেন জীবন সুন্দর, পাপ হবে। তার কাছে এইসব কোন কিছুই কাজ করে না। আমরা যত যাই বলি না কেন? সে হয়তো তার দৃষ্টিতে সঠিক কাজটাই করেছে। আমি কেন জানি এটা জোর দিয়েই বলতে চাই, সে তার দিক দিয়া ঠিক কাজটাই করেছে।
আমরা আমাদের দৃষ্টিতে নিজেদের কমফোর্ট জোন থেকে ভাবতেছি বলতেছি, কাজটা ঠিক হয় নাই। কিন্তু তার দৃষ্টিতে ঐটাই ঠিক। সে চলে যেতে চেয়েছে তাই নিজের ইচ্ছায় চলে গেছে। এখানে আমাদের কিছু বলার বা কিছু করার নাই। অন্তত চলে যাওয়ার পরে, যেখানে সে যখন ছিল তখন কিছুই করি নাই। সেটা আমার ভাইয়ের ক্ষেত্রেও তাই…
শেষ বাসাটায় এভাবেই ১টা বছর কাটিয়ে দিলাম, একা একা অথবা অনেক নির্ঘুম রাতে অশরীরি কাউকে নিয়ে। অথবা কেউ ছিল বা কেউ ছিল না।
এখন নতুন এলাকায়, নতুন বাসায়…
২৩ কার্ত্তিক ১৪৩২
